কক্সবাজারে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ : ১৩ বছরেও উদ্বোধন হয়নি

শংকর বড়ুয়া রুমি ◑

এক যুগের বেশী আগে নির্মিত হলেও ‘জেলার সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম’ স্মৃতিফলকে অন্তর্ভূক্ত না হওয়ার বির্তকে উদ্বোধন হয়নি কক্সবাজার জেলার ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ’; এতে অযতœ আর অবহেলায় পড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের এ স্মৃতিস্তম্ভটি।

এ নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাসহ জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মিদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকে বাদপড়া জেলার সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্তির দাবিতে কক্সবাজারে বিক্ষোভও হয়েছে একাধিকবার। স্থানীয়দের এ আপত্তির কারণে নির্মাণের ১৩ বছর পরও উদ্বোধন করা যায়নি স্মৃতিস্তম্ভটি।

বিগত ২০০১-২০০৬ সালের বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সারাদেশের প্রতিটি জেলায় নির্মিত হয় ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ’। বিগত ২০০৬ সালে কক্সবাজার কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের এ ‘স্মৃতিস্তম্ভটি’ নির্মাণ করে গণপূর্ত বিভাগ।

মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় স্মৃতিস্তম্ভটির নামফলকে উৎকীর্ণ করা হয় ‘জেলার ১০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার’ নাম। এঁরা হলেন, শহীদ আব্দুল হামিদ, গোলাম কাদের, গোলাম সাত্তার, ক্যাপ্টেন মকবুল আহমদ, সিদ্দিক আহমদ, হাবিলদার আবুল কাশেম, এজাহার মিয়া, সিপাহী লাল মোহাম্মদ, শামসুল আলম ও এস এম জাহাঙ্গীর।

এতে বাদপড়ে জেলার আরো বেশ কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম।

এ নিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হওয়ার পরপরই স্থানীয় অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম না দেখে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ক্ষোভ প্রকাশ করে।

বাদপড়া সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্মৃতিফলকে অন্তর্ভূক্ত করার দাবিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে নেমেছিল।

কিন্তু স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের ১৩ বছরে স্মৃতিফলকে জেলার বাদপড়া সকল মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্তি তো দূরের কথা উদ্বোধন করাও যায়নি।

তবে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকে অন্তর্ভূক্ত না হওয়া জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের একটি তালিকা মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এরই আলোকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে যথার্থ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত না হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের প্রথম শহীদ মোহাম্মদ শরীফ চেয়ারম্যান, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাবের আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) ছাত্র এটিএম জাফর আলম এবং চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাসের সময় প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ হওয়া সিপাহী আকতার হোসাইন। এছাড়াও তালিকায় আরো যাঁদের নাম এসেছে তাঁরা হলেন, শহীদ সুভাষ, ফরহাদ, মো. ইলিয়াছ মাস্টার, এনামুল হক, আমির হামজা, হাবিলদার রহিম বখশ, মেহের আহমদ, জোনাব আলী, ভট্ট মহাজন, সিপাহী আবুল হোসেন, মাস্টার শাহ আলম, বশির আহমদ, কবির আহমদ, অজিত পাল, নির্মল ধর, মোহাম্মদ আলী, পিয়ারী মহাজন, স্বপন মহাজন, মনিন্দ্র নাথ দে, নুরুচ্ছফা চৌধুরী, জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরী, সতীশ দে ওরফে সতীশ মহাজন, মো. শামসুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, অনিল কান্তি দাশ ও শশাঙ্ক বড়–য়া প্রমুখ।

কক্সবাজারের স্মৃতিস্তম্ভটি বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় নির্মিত হলেও এক দশকের বেশী ক্ষমতায় থাকা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও এর নামফলকে বাদপড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্ত না হওয়াটা খুবই দু:খজনক বলে মন্তব্য করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কক্সবাজারের সভাপতি সত্যপ্রিয় চৌধুরী দোলন।

দোলন বলেন, স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হওয়ার পর নামফলকে শুধুমাত্র ১০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম দেখে কক্সবাজারের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মিরা ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছিল। বাদপড়া সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্তির দাবিতে বিক্ষোভও হয়েছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়নের আলোরমুখ দেখেননি।

আগামী বিজয় দিবসের আগেই কক্সবাজারের বাদপড়া সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্মৃতিফলকে অন্তর্ভূক্তির দাবি জানান এ সাংস্কৃতিক সংগঠক।

স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকে বাদপড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্তি আন্দোলনের সংগঠক ও জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শহীদুল্লাহ শহীদ বলেন, বিগত ২০০৬ সালে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হওয়ার পরপরই ছাত্র ইউনিয়ন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে সমন্বয় করে বাদপড়া শহীদদের নাম সংযোজনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলনের প্রতীকি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন, মানববন্ধন, অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও।

তৎসময়ে বাদপড়া শহীদদের নামের একটি তালিকা জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল জানিয়ে সাবেক এ ছাত্রনেতা বলেন, দীর্ঘ ১৩ বছরেও স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকে বাদপড়া শহীদদের নাম সংযোজন করে উদ্বোধন করা হয়নি। অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে স্মৃতিস্তম্ভটি।

এ আন্দোলনের সঙ্গে জেলার মুক্তিযোদ্ধারাও সংহতি জানিয়েছিল উল্লেখ করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম জেলার সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, জেলা সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্মৃতিস্তম্ভের ফলকে সংযোজন না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও আপত্তি জানিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে বাদপড়া শহীদদের নামের একটি তালিকা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের কাছে জমা দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে জেলা প্রশাসনকে আবারো তাগাদা দেয়া বলে জানান এ মুক্তিযোদ্ধা।

এ নিয়ে কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বিগত ২০০৬ সালে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভটি’ নির্মাণের জন্য জেলা পরিষদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। যেটির নির্মাণকাজ সাড়ে ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করেছিল গণপূর্ত বিভাগ।

পরবর্তীতে সেটি দেখভালের জন্য জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল বলে জানান জেলা পরিষদের এ প্রধান নির্বাহী।

এ ব্যাপারে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারে নির্মিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকে বেশ কয়েকজন শহীদদের নাম বাদপড়ার বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে তারা বাদপড়া শহীদদের নামের একটি তালিকাও জমা দেয়। তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে বাদপড়া শহীদদের নাম স্মৃতিফলকে সংযোজনের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে জানান জেলা প্রশাসক।