বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে ঢাকা-চট্টগ্রামকে ছাড়িয়েছে কক্সবাজার

ডেস্ক রিপোর্ট ◑ পর্যটন নগর কক্সবাজারে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিরে অজস্র এনজিও প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কক্সবাজার জেলায় কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। সেসব প্রতিষ্ঠানের লোকজনসহ দক্ষিণের এই সমুদ্রশহরে বসবাসকারীদের ৮০ ভাগই বিভিন্ন বাড়িতে ভাড়াটিয়া।

আর এই সুযোগকে মওকা হিসেবে পেয়েছেন বাড়ির মালিকরা। কোনো নিয়মনীতি না মেনেই যথেচ্ছাচার ভাড়া বাড়িয়ে চলেছেন তারা। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ভাড়া বৃদ্ধিতে কক্সবাজারের বাড়ি মালিকরা ঢাকা-চট্টগ্রামকেও পেছনে ফেলেছে।

দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হওয়ায় কক্সবাজারে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা। এই পর্যটনকে ঘিরে শহরটিতে কর্মরত বিভিন্ন অঞ্চলের অজস্র মানুষ। তার সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর কাজ করছে এমন এনজিও প্রতিষ্ঠানের লোকজনও রয়েছেন প্রচুর। শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবেই তাদের থাকতে হচ্ছে। আর এই সুযোগে বাড়ি মালিকরা যেমন খুশি ভাড়া বৃদ্ধি করছেন।

কক্সবাজার শহরসহ ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত সব এলাকাতেই বাসাভাড়া বাড়ছে। লাগামহীন বাড়ি ভাড়ায় বিপর্যস্ত নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বৃদ্ধি করে চলেছেন। সেই সঙ্গে বেড়েছে নিত্যপণের দামও।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের আগে দুই রুমের যে বাসার ভাড়া ছিল সর্বনিম্ন ৮ হাজার টাকা, তা এখন ১৫ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। ভাড়া বৃদ্ধির পেছনে এনজিওগুলোর প্রভাব রয়েছে। কারণ রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর তারা বাছবিচার ছাড়াই অনেক বেশি টাকা দিয়ে বিভিন্ন বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। এতে করে বাড়ি মালিকরা সাধারণ বাসিন্দাদের ভাড়াও বাড়িয়েছে। নিরুপায় কোনো ভাড়াটিয়া এর প্রতিবাদ করলে বাসা ছাড়ার নোটিস ধরিয়ে দিচ্ছেন মালিকরা। সম্প্রতি এক ভাড়াটিয়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ায় সেই ঘটনা গড়িয়েছে থানা পর্যন্ত।

বাড়িওয়ালারা বলছেন, এনজিওদের দুই-তিনগুণ বৃদ্ধিতে ভাড়া দেয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা ভাড়া বৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই।

অন্যদিকে ভাড়াটিয়ারা বলছেন, প্রতি বছর লাগামহীনভাবে বাড়ছে বাসা ভাড়া। ৬ মাস পর বা বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানো যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না কোনো আইনকানুন। বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে মালিকের কথাই যেন আইন। ভাড়াটিয়াদের ভাড়া রসিদে দেয়ার নিয়ম থাকলেও মালিকরা সেটিও দিচ্ছেন না।

শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকার আনোয়ার নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘নতুন বছরের শুরুতেই বাসা ছেড়ে দিতে মালিকের কাছ থেকে অনেকেই ভাড়া বৃদ্ধির লাল নোটিশ পেয়েছেন। বিদ্যমান হারে বাসাভাড়া দিতে এমনিতেই হাঁসফাঁস অবস্থা শহরবাসীর। সেখানে হোটেলে সামান্য চাকরি করে বাসাভাড়া দেয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।’

তিনি বলেন, ‘ভাড়া বৃদ্ধি করার মূল কারণ কক্সবাজারে সক্রিয় প্রায় ২০০ এনজিও। তারা থাকছে প্রায় শহরে। সাধারণ মানুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি বাসাভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন এনজিওর কর্তাব্যক্তিরা। বাড়ির মালিকরা সেই হিসেবে সাধারণ ভাড়াটিয়াদেরও ভাড়া বৃদ্ধি করছেন।’

এদিকে কক্সবাজারে বসবাসকারী মানুষের ৮০ ভাগই বিভিন্ন জেলা থেকে আসা। তারা পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। এভাবে বাসাভাড়া বৃদ্ধি ভাবিয়ে তুলেছে তাদের। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে।

জানা যায়, ৫ হাজার টাকার বাড়ি ভাড়া ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে এখন আট থেকে দশ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। আর ১০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দুই হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা বাড়িয়ে এখন নেয়া হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। অন্যদিকে বড় আকারের ২০ হাজার টাকার বাসা ভাড়া বাড়িয়ে এখন নেয়া হচ্ছে ২৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা।

তার ওপর এনজিওদের জন্য সাধারণরা কোনো বাসা ভাড়াও পাচ্ছেন না। শহরের কোথাও কোনো নতুন বাড়ি তৈরি হলেই সেখানে অগ্রিম টাকা দিয়ে এনজিওতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাড়া নিয়ে নিচ্ছেন।

মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফের চিত্র আরও নাজুক। এই দুই উপজেলায় বাড়ি ভাড়া দেয়া এখন অন্যতম আয়ের উৎস হয়েছে বাড়ি মালিকদের। এমনও খবর আছে যে, গরুর গোয়াল ঘর পর্যন্ত একটু পরিচর্যা করে বাসা বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছেন তাদের কেউ কেউ। আগে ওই এলাকায় যে বাসা ৫০০ টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত তা এখন ৫ হাজার টাকায় পাওয়া দুষ্কর।

মিয়ানমারের রাখাইনে নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত। প্রায় দশ লাখের মতো রোহিঙ্গাকে ঘিরে কাজ করছে দেশি-বিদেশি অজস্র এনজিওসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজন। সেসব সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের কারণে গোট জেলাজুড়ে বেড়েছে ভাড়া বাসার চাপ। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন বাড়ির মালিকেরা।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিজ ফোরামের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী জানান, ‘বাড়িওয়ালা লোভে পড়ে পুরাতন ভাড়াটিয়াদের পর্যন্ত বের করে দিচ্ছেন। এমনও দেখা যায় ৪-৫ হাজার টাকা দামের বাসা ভাড়া দিচ্ছে ৮-১০ হাজার টাকায়। অগ্রিম নিচ্ছে ৫০-৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। একারণে কক্সবাজারের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার শহরে বাড়িভাড়া বাড়ার বিষয়টি আমি অবগত। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। এ আইন প্রয়োগে শহরের আশপাশে বাড়ির মালিকদের সঙ্গে মিটিং করার পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’