মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন আমাদের জন্য সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সা¤প্রতিক সময়ে সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষ ও বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়ায় এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর পেছনে ভূরাজনীতিরও একটা ইন্ধন রয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর আরো চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
রাজধানীর বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে শনিবার এডিটরস গিল্ড আয়োজিত বাংলাদেশের ‘রোহিঙ্গা সংকট-সীমান্ত পরিস্থিতি-ভূরাজনীতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। এ সময় তারা সীমান্তে মিয়ানমারের গোলাবন্ধে সেনা মহড়ারও পরামর্শ দেন।
শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘে দেয়া ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে শ্যামল দত্ত বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রলম্বিত হতে থাকলে তা উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। মিয়ানমারের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরো দুরূহ করে তুলছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সাল থেকে যে সংকটটি শুরু, যদিও সংকটের আরো দীর্ঘ একটি প্রভাব আছে এবং সেই প্রভাবের ফলে গত কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। কিন্তু সংকটটি সবচেয়ে বেশি বড় হয়েছে গত ৫ বছরে। বিশেষ করে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে যখন একসঙ্গে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসা শুরু হয়েছে। এখন প্রায় ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে এবং তাদের প্রত্যাবাসন কবে হবে, আদৌ তারা ফেরত যাবেন কিনা বা গেলে কীভাবে যাবে- সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই, স্পষ্ট কোনো চিত্রও
পাওয়া যাাচ্ছে না। এটি এক ধরনের হতাশা তৈরি করেছে। এর ফলে সংকট আছে। এরই মধ্যে সম্প্রতি মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে গোলাগুলি এবং ভূরাজনীতির যে নতুন পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে তাতে সংকট আরো জটিল হয়েছে। উল্টো মিয়ানমার আমাদের দোষারোপ করছে। এখানে অনেকগুলো বিদ্রোহী গ্রুপের অস্তিত আছে এবং তারা গোলাগুলি করছে। আসলেই কী তাই; নাকি এখানে অন্য কোনো প্রেক্ষিত আছে?
একই প্রসঙ্গ ধরে আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, যারা কথায় কথায় নিষেধাজ্ঞা দেয় তাদের উচিত মিয়ানমারের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে এটা দেয়া। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে তাদের বলা উচিত- এভাবে চলতে পারে না। সুইফট সিস্টেম থেকে মিয়ানমারকে বাদ দেয়া উচিত। কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধানের দিকে আমাদের এগোতে হবে। সমস্যার কথা চিন্তা করে আমাদের কিছু মিসাইল কক্সবাজারের দিকে মোতায়েন করা উচিত। সীমান্ত এলাকায় ভারত ও চীনের কিছু ইপিজেড বসিয়ে দেয়া উচিত। পর্দার আড়ালে মিয়ানমারের সঙ্গেও একটি ডিপ্লোম্যাসি করা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভূরাজনীতির ভূমিকা সব সময়ই আছে। এখানে নিঃসন্দেহে এর একটি প্রভাব আছে। রোহিঙ্গা সমস্যার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে সেটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এটি বেড়ে চললেও আমরা কিন্তু ভিকটিম না। মিয়ানমারের আচরণ সবার জন্যই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এটিকে ভালোভাবেই মোকাবিলা করছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ বলেন, মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে সেখানকার অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটা প্রক্রিয়া আমরা দেখছি। সীমান্তে আমরা নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক রেখেছি। তবে ডিপ্লোম্যাসির ক্ষেত্রে অপ্রতুলতার কথাও সামনে আসছে।
তবে তিনি এও বলেন, নিরাপত্তা এবং যুদ্ধ বন্ধ করতে জাতিসংঘ ব্যর্থ। বিশেষ করে এসব নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশ্ন আছে; তখন সংস্থটি কিছু করতে পারে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ কিছু করতে পারেনি এবং তাকে করতেও দেয়া হয়নি। তবে জাতিসংঘের কিছু প্রতিষ্ঠান রোহিঙ্গা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই সংকট বেশি দিন দীর্ঘায়িত হলে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁঁকি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে থাকা আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদেরও পাশে টানার চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গা যুবকরা যদি তাদের মাতৃভূমি জন্য লড়াই শুরু করে তাহলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে! এত অস্ত্র কোথা থেকে আসছে? আন্তর্জাতিক মহল সবাই সব জানে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, অং সান সু চি ক্ষমতা হারানোর পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের মনোযোগে পরিবর্তন এসেছে। ক্ষমতা দখলকারীরা দুর্বল থাকায় সেই সুযোগ নিচ্ছে অভ্যন্তরীণগোষ্ঠী। আরাকান আর্মিসহ অন্যরাও নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই সুযোগটা আন্তর্জাতিক বিজনেস কমিউনিটিও নিচ্ছে, অস্ত্র ব্যবসা বাড়ছে।
আগে হয়তো এই ব্যবসা ‘ফিফটি ফিফটি’ ছিল। এখন বেশি সুযোগ নিচ্ছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কিছু দেশ বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। আইসিজেতে চূড়ান্ত রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে।
আন্তর্জাতিক আদালতে দুটি রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটি বুঝেই মিয়ানমারের জান্তারা একটি সংঘাত চাইছে। তারা এর সঙ্গে বাংলাদেশকে জড়াতে চাইছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধবে বলে যেসব কথা বলা হচ্ছে- তা আমি মনে করি না। মিয়ানমার আর্মির এই মুহূর্তে শক্তি থাকলেও বাংলাদেশে আক্রমণ করার সক্ষমতা নেই। আমরা ডিফেন্সিভ অবস্থায় আছি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও ভারতের কী অবস্থান সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভূরাজনীতিগত কারণে দুটি বিষয় আমি এখানে বাদ দিতে পারছি না। তাদের এই সংঘাতের কারণে এসব ঘটছে। রোহিঙ্গা বিষয়টিও অনিষ্পন্ন থাকছে। আর এখানে ভূরাজনীতির বিষয়টি জড়িত। এটাও ঠিক তাদের বাদ দিয়ে সমস্যা সমাধান হবে না।
এখন যে বিষয়টি দাঁড়িয়েছে, প্রতিদিন গোলাগুলি হচ্ছে, জনগণকে সরাতে হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করছি। সামরিক দৃষ্টিতে দেখলে এটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের লঙ্ঘন। এর উপায় সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক উপায়ে নিষ্পন্ন করতে হবে। টেকসই সমাধানে যেতে হলে কূটনৈতিক উপায়ে কাজ করতে হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ২০১৭ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকা জোরদার অব্যাহত রাখতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আব্দুর রব খান বলেন, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। স¤প্রতি সীমান্তের ওপারে সংঘাতে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আরো পেছনে চলে যাচ্ছে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় জান্তা সরকার দুর্বল থাকায় ইচ্ছাকৃতভাবেই এমনটি করতে পারে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-