টেকনাফের আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারিদের শতকোটি টাকার সম্পদ রক্ষায় নানা তৎপরতা

সারোয়ার সুমন, সমকাল •

আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি তিনি। টেকনাফে তাঁর কথাই যেন আইন। কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। চড়েন পাজেরো গাড়িতে। পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য আছে ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি। ব্যাংকেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছিল। তবে সেই টাকার কিছুই এখন নেই ব্যাংকে। আলোচিত এই ইয়াবা কারবারি হলেন আবদুর শুক্কুর। ১০১ ইয়াবা কারবারির সঙ্গে আত্মসমর্পণ করার আগেই ব্যাংকে থাকা টাকা তুলে নিয়েছেন। এখন তাঁর মনোযোগ বাড়ি ও গাড়ি রক্ষায়।

টেকনাফের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই আবদুর শুক্কুর।  ইয়াবার কারবার করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। শুধু আবদুর শুক্কুর নন, আত্মস্বীকৃত সব ইয়াবা কারবারি এখন তাঁদের শতকোটি টাকার সম্পদ রক্ষায় নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ করার সুযোগ দেওয়ার আগে কিছু শর্ত দিয়েছিল সরকার।

এসব শর্তের মধ্যে ছিল ‘ইয়াবা ব্যবসায় নিজের, পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে অর্জিত সব সম্পদ দুদক, সিআইডির মানি লন্ডারিং শাখা ও এনবিআরের মাধ্যমে যাচাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ রাষ্ট্রের অনুকূলে অবৈধ সম্পদ সরাসরি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা না থাকায় এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদ রক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন অপরাধীরা। এরই মধ্যে শূন্য করে ফেলেছেন তাঁরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।

২০১৯ সালে কক্সবাজারে একের পর এক মাদক কারবারি ক্রসফায়ারে নিহত হলে আতঙ্ক তৈরি হয় এই কারবারিদের মধ্যে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন দোষ স্বীকার করে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ করার সুযোগ দেয়। গত ফেব্রুয়ারিতে এমন সুযোগ গ্রহণ করেন ১০২ জন। তাঁদের মধ্যে একজন মারা যাওয়ায় গত ২৩ নভেম্বর ১০১ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন আদালত। প্রত্যেককে দেড় বছর করে কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে যাঁরা ২০১৯ সাল থেকে কারাগারে ছিলেন, তাঁদের এ সাজা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। যাঁরা পলাতক তাঁদের আত্মসমর্পণ করে সাজা ভোগ করার কথা বলেছেন আদালত। কিন্তু এ রায়ের পর্যবেক্ষণে আত্মস্বীকৃত মাদক কারবারিদের সম্পদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

রায় ঘোষণার পরপরই মোবাইল নাম্বার বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যান শুক্কুরসহ পলাতক থাকা ৮৪ কোটিপতি আসামি। তবে জামিন নিয়ে এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসছেন। এখনও অপরিচিত কারও ফোন রিসিভ করছেন না তাঁরা। সমকাল থেকে কয়েকজনকে বারবার ফোন করা হলেও কেউই রিসিভ করেননি। অভিযুক্তদের না পেয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় আবদুর রহমান বদির সঙ্গে। তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বদির স্ত্রী বর্তমান এমপি শাহীন আক্তারকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারটি দেখছেন আদালত। আমার কোনো বক্তব্য নেই।’ এটি বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। বক্তব্য জানতে কক্সবাজারের পুলিশ ও সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছি কয়েক মাস আগে। সবকিছু এ মুহূর্তে বিস্তারিত বলতে পারব না। তবে আত্মস্বীকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে সরকার কিছু শর্ত দিয়েছিল। সেসব শর্ত অনুসরণ করেই কাজ করছি। অপরাধীদের কেউই ইয়াবার টাকায় গড়া সম্পদ রক্ষা করতে পারবেন না। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এটি নিয়ে কাজ করছে।’ আত্মস্বীকৃত কারবারিদের মধ্যে কতজনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে, কতজনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং শাখা মামলা করেছে তা তিনি জানেন না বলে মন্তব্য করেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, ‘মামলার এজাহার এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত ১০১ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারিকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন। এ রায় ইয়াবা কারবার বন্ধে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা এজাহার ধরে মামলা পরিচালনা করি। কেন মামলার এজাহারে সম্পত্তির ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি তা জানা নেই। নিয়ম অনুযায়ী এ বিষয়টি এখন দুদকসহ সরকারের অন্য সংস্থাগুলো দেখবে।’

শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলার মাধ্যমে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কথা থাকলেও সেই প্রক্রিয়া এগোয়নি সেভাবে। আত্মস্বীকৃত ১০১ কারবারির মধ্যে অর্ধেকই মাস কয়েক পর জামিনে মুক্ত হন। জামিন পেয়েই তাঁরা ব্যাংক থেকে তুলে ফেলেন অর্থ। এ জন্য ১০১ কারবারির মধ্যে মাত্র ১২ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হয়েছে। আবার যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের ব্যাংকেও নেই কোনো অর্থ। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন এবং ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। ১২৩ কারবারির মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের মার্চে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

তাঁদের কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলেও মেলেনি টাকার হদিস। প্রথম দফায় ২০ কারবারির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল আর্থিক অনুসন্ধান। পরে অন্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে মামলা করার কথা থাকলেও তা আর করা হয়নি।

যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাঁরা হলেন- টেকনাফের বাসিন্দা সাবেক এমপি বদির সৎভাই আবদুর শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, ফয়সাল রহমান ও আপন বড় ভাই আবদুল আমিন ওরফে আমিনুর, হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরুল হুদা ও তাঁর ভাই নুরুল কবীর, টেকনাফ সদরের ইউপি সদস্য এনামুল হক, শীর্ষ ইয়াবা কারবারি একরাম ও তাঁর ভাই আব্দুর রহমান, হ্নীলার ইউপি সদস্য জামাল হোসেন ও তাঁর ছেলে শাহ আজম ও মোহাম্মদ আলী।

সমকাল/ এসএস/ সিবিজে