সেন্ট মার্টিনে নিজেদের উৎপাদিত বলে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে পাকিস্তানি শুঁটকি

আবদুল কুদ্দুস রানা •

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের অনেকেই ফেরার সময় সেখান থেকে শুঁটকি কিনে আনেন। পর্যটকদের কাছে ‘নিজেদের উৎপাদিত’ শুঁটকি নাম দিয়ে বেশ চড়া দামেই শুঁটকি বিক্রি করেন স্থানীয় বাজারের বিক্রেতারা। প্রকৃতপক্ষে, সেগুলোর অধিকাংশই চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে কিনে আনা পাকিস্তানি শুঁটকি। ভারত-মিয়ানমার থেকে আনা শুঁটকিও পাওয়া যায় কয়েকটি দোকানে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্বীপের কয়েকজন শুঁটকি ব্যবসায়ী বলেন, সেন্ট মার্টিনে এখন দৈনিক চার হাজারের বেশি পর্যটক আসছেন। অনেকেই দ্বীপের শুঁটকি কিনতে চান। কিন্তু এত শুঁটকি দ্বীপে উৎপাদন হয় না। চাহিদার ৯০ শতাংশ শুঁটকি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। কিন্তু পর্যটকদের তা বুঝতে দেওয়া হয় না। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মনে করে পাকিস্তানি শুঁটকি কিনে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন পর্যটকেরা।

৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে সেন্ট মার্টিন জেটিঘাট অতিক্রম করে ৭০-৮০ গজ সামনে গিয়ে দেখা যায়, বড় বড় শুঁটকির দোকান। পর্যটকেরা সেখান থেকে কয়েক কেজি করে শুঁটকি কিনছেন। দোকানে পলিথিনে মুড়িয়ে অনেক শুঁটকি টাঙানো। প্রতি কেজি রাঙাচকি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছিল ১০০০ টাকায়, কোরাল ১০০০, বোয়াল চান্দা ১২০০, ফ্লায়িং ফিশ ৬০০, চাপিলা ৩০০, ছুরি ৭০০ থেকে ১২০০, মলা ৬০০, অলুয়া ৬০০, ছোট চিংড়ি ৪০০, লইট্যা ৬০০, ভেটকি ২৫০, ফকির চান্দা ১২০, বড় টোনা (মাইট্যা) ১৫০০, করইত্যা ৬০০, বাইন ৮০০, লাক্ষ্যা ১৭০০, রূপচাঁন্দা ৩৫০০ এবং কালো চান্দা ১৮০০ টাকায়।

দোকানের মালিক দ্বীপের পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা মনজুর আলম (৫৫) বলেন, লইট্যা, ছুরি, কাচকি, চিংড়ি শুঁটকিগুলো চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে আনা হয়েছে। বাকি শুঁটকি তিনি নিজে সেন্ট মার্টিনে উৎপাদন করেন। ১৫ বছর ধরে তিনি শুঁটকি উৎপাদন ও বেচাবিক্রি করছেন। দ্বীপের অন্যান্য দোকানে পাকিস্তানি শুঁটকি বেচাবিক্রি হলেও তিনি এই কাজ করেন না।

দোকানের সামনে কথা হয় দ্বীপের মাছ ব্যবসায়ী জমির আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিনসহ টেকনাফ-কক্সবাজারের কয়েক হাজার ট্রলারের জেলেদের জালে দুই মাস ধরে তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। এ কারণে শুঁটকির উৎপাদনও অনেক কমে গেছে। পর্যটকেরা স্থানীয় শুঁটকি কিনতে আগ্রহী। গত বছর এ সময়ে দ্বীপে ১২০টির বেশি দোকানে কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়েছিল। এবার শুঁটকির দোকান ৩০টির মতো। অধিকাংশ দোকানের শুঁটকি পাকিস্তান ও ভারত থেকে আনা।

কয়েকটি দোকানের মালিক ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর প্রতিটি দোকানে গড়ে দৈনিক ৬০-৭০ হাজার টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়েছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫-৫০ হাজার টাকা। তবে গত বছরের তুলনায় এবার শুঁটকির দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে, মাছের গুণমানও কম।

৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বাজারের একটি দোকান থেকে তিন কেজি লইট্যা শুঁটকি কেনেন সিরাজগঞ্জের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন। তাঁর কাছ থেকে প্রতি কেজির দাম রাখা হয় ৯০০ টাকা। পাশের আরেকটি দোকানে একই শুঁটকি বিক্রি হচ্ছিল ৭৮০ টাকায়। এ নিয়ে দুই দোকানদারের মধ্যে ঝগড়া বাধলে শুঁটকি আমদানির রহস্য বেরিয়ে আসে। পর্যটকেরা তখন জানান, এই শুঁটকি সেন্ট মার্টিনের না, পাকিস্তান থেকে আনা।

আমজাদ হোসেন (৪৮) বলেন, সেন্ট মার্টিনে শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে কক্সবাজারের চেয়েও বেশি দামে। কক্সবাজার সৈকতের দোকানপাটে ছুরি শুঁটকি কেজিতে ৬০০-৮০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকাও হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পর্যটকেরা চড়া মূল্যে শুঁটকি কিনে ঠকছেন।

দেখা গেছে, পর্যটকদের অনেকে সামুদ্রিক মাছ ঠিকমতো চেনেন না। দোকানের কর্মচারীরা তাঁদের কোরালের জায়গায় কামিলা মাছ, রূপচান্দার জায়গায় টেকচান্দা, মাইট্যার জায়গায় চাপা শুঁটকি ধরিয়ে দিচ্ছেন। কিছু রেস্তোরাঁতে কোরাল মাছ বলে পাঙাশ মাছ ভেজে খাওয়ানো হচ্ছে। এসব তদারকি কিংবা দেখার কেউ নেই সেখানে।

সেন্ট মার্টিন দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিব খান বলেন, কয়েক হাজার পর্যটকের খাবারের জন্য সামুদ্রিক মাছ কোরাল, রূপচান্দা, মুরগি, মাংস, ডিম সংগ্রহ করতে হয় ৩৪ কিলোমিটার দূরের টেকনাফ থেকে। মাছের রাজ্য সেন্ট মার্টিনে এখন মাছের আকাল চলছে। চাহিদা পূরণের জন্য কিছু শুঁটকি আনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। পর্যটকদের মধ্যে যাঁরা শুঁটকি সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তাঁরা দেখেশুনে শুঁটকি কেনেন।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, একসময় দ্বীপে উৎপাদিত শুঁটকি ট্রলার বোঝাই করে টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম সরবরাহ হতো। দ্বীপের সৈকতে শুঁটকি উৎপাদনের ধুম পড়ত। এখন সবকিছু ফাঁকা। তবে সেন্ট মার্টিনে লাক্ষ্যা, রাঙাচকি, ফ্লায়িং ফিশ, পোপা, মাইট্যাসহ কিছু মাছের শুঁটকি হচ্ছে। শুঁটকি কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, এমন অভিযোগ তিনি পাননি। এ কারণে শাস্তির আওতায় আনা যায় না কাউকে।