ইয়াবার টাকায় অর্জিত সম্পদ ভোগের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন

এইচএম এরশাদ ॥

স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকারের বিশেষ আইনী সহায়তা পেতে কক্সবাজারের টেকনাফে ১০২ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করলেও এখনও বাইরে রয়ে গেছে আরও বহু মাদক কারবারি। এরমধ্যে খুচরা কারবারি ছাড়াও রয়েছে বড়সড় ডিলারও। এরা আত্মগোপনে থেকে নানা কৌশলে পার পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তালিকাভুক্ত সহস্রাধিক ইয়াবা গডফাদারের মধ্যে বেশিরভাগই নিজকে সমর্পণ না করায় এখনও পুরোপুরি স্বস্তি আসেনি এলাকায়। এদিকে, নিজেকে আইনের কাছে সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এ কারবারিরা অনৈতিক পন্থায় অর্জিত অঢেল অর্থ ও সম্পদ ভোগ দখলের অধিকার পেতে যাচ্ছে কিনা সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

টেকনাফ এবং উখিয়ার সাধারণ মানুষ এই ইয়াবা কারবারিদের দৌরাত্ম্যে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। কেননা, মাত্র ক’বছর আগেও যাদের ছিল দিনে এনে দিন খাওয়া অবস্থা, বর্তমানে তারা কোটি টাকার সম্পদের মালিক। রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ি। ইয়াবার টাকায় এলাকায় তারা যথেষ্ট ক্ষমতাবান। রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রও। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান এনে তারা সরবরাহ করে আসছিল চট্টগ্রামসহ সারাদেশে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণ গেছে ৬০ মাদক কারবারির। সাঁড়াশি এ অভিযানে কোণঠাসা এরা রয়েছে জীবনশঙ্কার মধ্যেও। এমন অবস্থায় তারা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটাই বাধ্য হয়েছে। তবে এ সংখ্যা মোট ইয়াবা কারবারির তুলনায় একটি ক্ষুদ্র অংশ বলে মনে করছে এলাকাবাসী।

এদিকে, মাদক ব্যবসার টাকায় রাতারাতি ধনবান হয়ে যাওয়া এ কারবারিদের বিরুদ্ধে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার বহির্প্রকাশও ঘটতে দেখা গেছে। সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে যারা সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করেছে, তাদের ওইসব বাড়ি-দালান প্রকাশ্যে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে দেখা গেছে। তবে এসব বাড়িঘর কারা ভাঙছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

মোঃ সোলতান নামে টেকনাফের একজন ব্যবসায়ী বলেন, গত জানুয়ারিতে একাধিক মাইক্রোবাসে চড়ে ইয়াবা সম্রাটদের বাড়িতে এসে নতুন নির্মিত দালান গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণে এসবের প্রতিবাদও কেউ করে না। অপরিচিত লোকজন ইয়াবা কারবারিদের আলিশান বাড়িগুলো ভেঙ্গে এবং যেসব ইঞ্জিনচালিত বোটে করে ইয়াবা আনত ওইসব বোটও আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণার পর জানুয়ারি মাসে পোড়া গেছে প্রায় অর্ধ শতাধিক ঘরবাড়ি। সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করলেও পুলিশের ভয়ে ইয়াবা সম্রাটরা ওসব দালানে থাকছে না। কেয়ারটেকার নতুবা স্বজনকে (যার বিরুদ্ধে ইয়াবার অভিযোগ নেই) ওই দালানে রেখে অন্যত্র গা-ঢাকা দিয়েছে শীর্ষ ইয়াবা সম্রাট। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত একাধিক ইয়াবা গডফাদারের (জনপ্রতিনিধি) দাপটে এবং প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে রয়েছেন বলে অভিযোগে জানা গেছে।

ইয়াবা কারবারিদের বাড়িঘরে ভাংচুর এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশের বক্তব্য হলো, এ বিষয়ে তারা অবগত নন। কেউ কোন ধরনের অভিযোগও করেনি। লিখিতভাবে জানানো হলে পুলিশ তদন্ত করে দেখবে। তবে স্থানীয় এলাকাবাসীর ধারণা, পুলিশের ইঙ্গিতেই ইয়াবা কারবারিদের বাড়িঘর ভাঙ্গা হচ্ছে।

এদিকে আত্মসমর্পণকারীদের অঢেল সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেয়ার দাবি জানিয়ে স্থানীয়রা বলছেন, এই ১০২ জন যদি সহজে ছাড়া পেয়ে তাদের সহায় সম্পদ ভোগ করতে পারে, তাহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এলাকায়। বন্ধ করা যাবে না ইয়াবা কারবার। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, এদের সম্পদ বহাল থাকলে সীমান্তের অনেকে ঝুঁকে পড়তে পারে ইয়াবা কারবারে। সুরম্য অট্টালিকা ও সহায় সম্পদ ফেরত পেলে স্থানীয় অনেকেই একই পন্থায় অঢেল বিত্তের মালিক হয়ে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কৌশল বেছে নিতে পারে। এ পন্থায় কালো টাকাকে সাদা করা সহজ হয়ে যাবে। তাই সর্বশেষ তালিকায় নাম উঠে আসা ১ হাজার ১৫১ জন এবং নাম আসেনি অথচ ইয়াবা কারবারে যারা জড়িত, তাদেরও আয়ের উৎস খতিয়ে দেখে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের হিসাব নিয়ে বাজেয়াফত করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, তালিকাভুক্তদের মধ্যে আত্মগোপনে আছে টেকনাফের হাজী সাইফুল করিম, জুবাইর ও চট্টগ্রামের নুর কামালসহ ৪৪ জন বড় কারবারি। শনিবার দুপুরে ১০২ ইয়াবা সম্রাট ও বিক্রেতার আত্মসমর্পণের পর টেকনাফ সীমান্তজুড়ে আতঙ্কে রয়েছে ইয়াবা কারবারিদের পরিবারের সদস্যরা। প্রশাসন আবার কখন অভিযানে নামে এই চিন্তায় তাদের কাটছে নির্ঘুম রাত। দিনের বেলায়ও এদের আগের মতো প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে গত শনিবারের পর এ চিত্র লক্ষণীয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থানে থেকে জোরালো অভিযানে নামবে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

গোয়েন্দাসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারে রয়েছে ইয়াবা তৈরির ৩৭টি কারখানা। ওই উৎপাদনকারীরা নানা মাধ্যমে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করে থাকে। অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা একঘরে অগণতান্ত্রিক মিয়ানমার বাংলাদেশকেই বেছে নিয়েছে তাদের উৎপাদিত এ মরণ নেশা ইয়াবা পাচারের রুট হিসেবে। যেহেতু কারখানা রয়ে গেছে, সেহেতু ইয়াবা আসা এত সহজে বন্ধ হয়ে যাবে তা অনেকেই মনে করেন না। আপাতত থমকে থাকলেও নতুন পন্থা বেরিয়ে আসতে পারে। সে কারণে ইয়াবা তৈরির কারখানা বন্ধ করা জরুরী।

মিয়ানমারে তৈরি ইয়াবা টেকনাফ হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে কত ধরনের কৌশল ও এজেন্ট রয়েছে তা প্রমাণ হয় এজতেমায় যোগ দেয়ার নামে গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি চালান ধরা পড়ার পর। গত শনিবার টেকনাফে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ধরা পড়ে একটি বড় চালান। হুজুর সেজে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল চালান। র‌্যাব সদস্যরা খবর পেয়ে লিংক রোড এলাকায় এজতেমার গাড়ি থেকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবাসহ সরোয়ার কামাল নামে এই ব্যক্তিকে আটক করে।

র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর মেহেদী হাসান বলেন, হানিফ পরিবহনের একটি বাসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা নিয়ে কক্সবাজার হতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার তথ্য ছিল তাদের কাছে। লিংক রোড এলাকায় বিশেষ চেকপোস্ট স্থাপন করে ওই গাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। তল্লাশিকালে ওই ব্যক্তি বেরিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তারপর আটক করে জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গ্যাস সিলিন্ডার থেকে বের করা হয় ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো। আটক ব্যক্তি টেকনাফের নয়াপাড়ার দুদু মিয়ার পুত্র। অভিযানে নানা কৌশলে ইয়াবা পাচারের ধরন ও পাচারকারীদের লেবাস দেখে ধারণা করা হয়, এ কারবারিদের চেহারা বা অবস্থান একই ধরনের নয়। আকারে ক্ষুদ্র এ ট্যাবলেট বহন ও বিক্রি সহজ এবং লাভজনক হওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছে।