মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি ৫৯৫৩ কর্মী

বিশেষ প্রতিবেদক :

ভিসা পাওয়াসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করেও উড়োজাহাজের টিকিট না পাওয়ায় ৫ হাজার ৯৫৩ জন বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বায়রা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। টিকিটের জন্য এ কর্মীদের পাসপোর্ট রয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে।

এর বাইরেও বিপুলসংখ্যক মানুষ মালয়েশিয়া যেতে স্থানীয় আদম ব্যবসায়ী এবং রিক্রুটিং এজেন্সিকে টাকা দিয়েছিলেন। তারাসহ কত কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা গতকাল শনিবার পর্যন্ত জানাতে পারেনি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। যেতে না পারা কর্মীর তালিকা বায়রার কাছে চাওয়া হয়েছে।

প্রায় ৩১ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি দাবি করে দায়ীদের শাস্তি দাবি করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে না পারার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি হবে। তিনি বলেছেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ২১ মার্চ মালয় সরকার জানিয়েছিল, বিদেশি কর্মীদের জন্য ৩১ মে বন্ধ হয়ে যাবে তাদের শ্রমবাজার। ৭০ দিন আগে জেনেও ভিসা পাওয়া সব কর্মীকে নির্ধারিত সময়ে পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ। ফ্লাইট সংকটে শেষ দুই সপ্তাহে ঢাকা-কুয়ালালামপুরের বিমান ভাড়া ২৫ হাজার থেকে বেড়ে লাখ টাকার বেশি হয়। তার পরও টিকিটের জন্য বিমানবন্দরে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ভিসা পাওয়া হাজারো কর্মী।

সরকার মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করলেও এ কর্মীরা ৫ থেকে ৭ লাখ দিয়েছেন রিক্রুটিং এজেন্সি এবং আদম ব্যাপারীদের। বায়রা মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, যেতে না পারা কর্মীদের টাকা ফেরত দেবে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি।

সরকার নির্ধারিত ৭৯ হাজার টাকা, নাকি কর্মী যত টাকা দিয়েছেন তার পুরোটাই ফেরত দেবে– প্রশ্নে তিনি বলেন, কর্মীর কাছে যত টাকা দেওয়ার প্রমাণ রয়েছে, তত টাকাই ফেরত পাবেন।

তবে বায়রার নেতারা বলেছেন, এজেন্সি কর্মীর সঙ্গে স্ট্যাম্পে যে চুক্তি করে, তাতে সরকার নির্ধারিত ব্যয় লেখা থাকে। বাড়তি টাকার রসিদ দেওয়া হয় না। আবার এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটকে টাকা দিয়ে চাহিদাপত্র কিনেছে। কর্মী পাঠাতে দেশীয় সিন্ডিকেটকে ঘুষ দিয়েছে। এই অবৈধ লেনদেনের প্রমাণ দলিল নেই। তাই সিন্ডিকেটের হোতারা টাকা ফেরত দেবে না। কর্মী কীভাবে বাড়তি দেওয়া টাকা ফেরত পাবেন?

জনশক্তি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিল ই-ভিসা। কর্মীর নিয়োগের সুযোগ ফুরিয়ে আসায় শেষ সময়ে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীরা ই-ভিসা দেওয়া শুরু করে। প্রায় ৩০ হাজার কর্মী ভিসা পান এ সময়ে। তা জেনেও এই কর্মীদের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর জন্য পর্যাপ্ত ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে পারেনি সরকার।

৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৮৪ নিয়োগ অনুমতির বিপরীতে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা জনশক্তি কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ছাড়পত্র দেয় ৪ লাখ ৯৪ হাজার ১০২ জনকে। জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সালের ৮ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ৭৭ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া পৌঁছেছেন। ছাড়পত্র পাওয়া বাকি ১৭ হাজার কর্মীর একটি অংশের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মালয় সরকার কালো তালিকাভুক্ত করেছে। ফলে তাদের যাওয়ার সুযোগ ছিল না।

২০১৫ সালে সিন্ডিকেট নামে পরিচিত ১০ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় ২ লাখ ৭৮ হাজার কর্মী পাঠিয়েছিল। এতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর ২৫ বাংলাদেশি এজেন্সিকে বাছাই করে মালয় সরকার। এগুলোও সিন্ডিকেট নামে পরিচিত। প্রত্যেক কর্মীর জন্য সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকরা নেয় ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। দেড় লাখ টাকায় ভিসা ‘কিনে’ ভুয়া চাকরিতে কর্মী পাঠানো হয়েছে। ফলে বহু কর্মী মালয়েশিয়া গিয়ে চাকরি পাননি। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির কথা জানিয়েছে।

সমকালের অনুসন্ধান অনুযায়ী, সিন্ডিকেটের চাঁদা এবং ভিসা কেনা বাবদ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত বায়রা নেতা রুহুল আমিন স্বপন সমকালকে জানিয়েছেন, শনিবার রাত ১০টা পর্যন্ত সব এজেন্সির কাছ থেকে জমা থাকা পাসপোর্টের হিসাব নেওয়া হয়েছে। তা অনুযায়ী ৫ হাজার ৯৫৩ কর্মী উড়োজাহাজের টিকিট না পাওয়ায় যেতে পারেননি। এখানে এমন কর্মীও আছেন, যাদের বিএমইটি ছাড়পত্র হয়নি।

জনশক্তি খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়োগের অনুমতি পেয়ে এজেন্সিগুলো গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা আদম ব্যাপারীরা বহু লোকের কাছ থেকে ১ লাখ, ২ লাখ করে টাকা নিয়েছে। যারা বিএমইটি ছাড়পত্র পাওয়ার ধাপ পর্যন্ত আসার আগেই শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। তারা এবং কালো তালিকায় পড়া নিয়োগকারীর কর্মীসহ অন্তত ৫০ হাজার মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মালয়েশিয়ায় যেতে না পেরে।

গত শুক্রবার বিমানবন্দরে ভিড় করা কর্মীদের একজন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের জহিরুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, আমিসহ ৬ জনের কাছ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সি জে জি আল ফালাহ ম্যানেজমেন্টের হয়ে কাজ করা আদম ব্যাপারী হারুন অর রশিদ। চার দিন বিমানবন্দরে বসিয়ে রেখেও টিকিট দেয়নি। জমি, গরু বিক্রি করে, সুদে ঋণ নিয়ে টাকা দিয়েছি। ৬ জনের ৩৩ লাখ টাকার জন্য এখন হারুন অর রশিদের পেছনে ঘুরছি।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়া কর্মীদের নির্ধারিত সময়ে পাঠাতে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জোরালো ভূমিকা ছিল না, এটি মানছেন একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তারা সমকালকে বলেছেন, সংকট এত তীব্র হতে পারে, তা মন্ত্রী, সচিব ধারণা করতে পারেননি।

গতকাল সিলেটে প্রবাসী প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, মালয়েশিয়া ৫ লাখের বেশি কর্মী নিয়োগের কোটা দিয়েছিল। বায়রার সঙ্গে কথা বলে কাদের ভিসা হয়েছে, কাদের হয়নি– এ তথ্য চাওয়া হয়েছিল। বায়রা তা দিতে পারেনি।

কর্মীদের মালয়েশিয়া পাঠাতে মন্ত্রণালয় যথেষ্ট ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে পারেনি– এ অভিযোগের জবাবে শফিকুর রহমান বলেছেন, বিমানের সঙ্গে কথা বলে ২২টি বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা এবং সময় বৃদ্ধির জন্য মালয়েশিয়া সরকারকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।