মিয়ানমারের তমব্রু খালে ব্রিজ নির্মাণ, ডুবে যাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প!

আবদুল আজিজ,বাংলা ট্রিবিউন ::

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তমব্রু খাল সংলগ্ন কাঁটাতারের বেড়া ঘেষে ব্রিজের নামে বাঁধ নির্মাণ করছে মিয়ানমার সরকার। নির্মাণাধীন ব্রিজটি মিয়ানমারের ভেতরে হলেও আগামী বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের অংশ। এমনকি ডুবে যাবে নো-ম্যানস ল্যান্ডের রোহিঙ্গা ক্যাম্পটি। পাশাপাশি বাংলাদেশের কুনারপাড়া গ্রামের অধিকাংশ এলাকায় সৃষ্টি হবে জলবদ্ধতা। এছাড়াও সীমান্তে স্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রায় ১০ হাজার মানুষের পানিবন্দি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে বিষয়টি নজরে এসেছে এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক।

তমব্রু নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাংলাদেশিরা বলছেন, মিয়ানামার তমব্রু সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তাড়াতে নতুন প্রচেষ্টা শুরু করেছে মিয়ানমার সরকার। কারণ, কোনও ধরনের রাস্তা নেই এমন একটি জায়গায় ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজন নেই। এটি নামেমাত্র ব্রিজ নির্মাণ। আসলে আগামী বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের পানি আটকে দিয়ে তমব্রু সীমান্তে খালের পাশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সরাতে এমনটি করছে মিয়ানমার সরকার। এর আগেও তমব্রু সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সরাতে নানা চেষ্টা করেছিল মিয়ানমার। ওই সীমান্তে দেশটির ভেতরে ঘন ঘন গুলিবর্ষণ, রাতে কাঁটাতার ঘেঁষে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশসহ নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এখন নতুন করে খালে ব্রিজ তৈরি নামে বাঁধ নির্মাণ কো হচ্ছে। এতে বর্ষা মৌসুমে নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ক্যাম্প, সীমান্তে বসবাসরত স্থানীয় অধিবাসী ও তাদের কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্তপথ রয়েছে ২৭১ কিলোমিটার। এরমধ্যে ২০৮ কিলোমিটার স্থলপথ ও ৬৩ কিলোমিটার জলসীমান্ত রয়েছে। তেমনই এক সীমান্ত, বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের কুনারপাড়া সীমান্তের তমব্রু খালের পাশে নো-ম্যাসন ল্যান্ডে আশ্রয় নেয় প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে এসে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে এই রোহিঙ্গারা খালেরপাড়ে গড়ে তুলেছে একটি বস্তি। এরপর থেকে মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টি এই রোহিঙ্গা বস্তির ওপর।

জানতে চাইলে তমব্রু সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়ে এই নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছি দেড় বছর আগে। এরপর মিয়ানমার সরকার এই নো-ম্যানস ল্যান্ড থেকে আমাদের সরানোর জন্য নানা ভয়ভীতি দেখিয়েছে। এবার নতুন করে চক্রান্ত শুরু করেছে তারা। তমব্রু খালে ব্রিজ নির্মাণের নামে বাঁধ দিচ্ছে মিয়ানমার। এতে করে আগামী বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলে রোহিঙ্গারা এখানে মরবে। আমি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য কামনা করছি।’

ওই ক্যাম্পের অবস্থানরত আরেকজন রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘আবারও নো-ম্যানস ল্যান্ড থেকে রোহিঙ্গাদের সরাতে নতুন পাঁয়তারা শুরু করেছে মিয়ানমার। যে কারণে তমব্রু খালে নতুন করে ব্রিজের নামে বাঁধ তৈরি করছে। এটি হলে খালে পানির স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে এবং বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের ভেতরের কোনারপাড়াসহ স্থানীয় কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে যাবে।’

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আবছার বলেন, ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডের মিয়ানমারের ভেতরে যে ব্রিজটি নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতে মনে হয় কোনও সড়কের জন্য নির্মাণ করছে না। শুধু তমব্রু খালে ব্রিজ নির্মাণ করার প্রয়োজন নেই। আগামী বর্ষা মৌসুমে খালের পাহাড়ি ঢলের পানি আটকে দিয়ে নো-ম্যানস ল্যান্ডের রোহিঙ্গাদের সরানোর চেষ্টা শুরু করছে। এতে করে শুধু রোহিঙ্গারা সরবে না, আমরা যারা বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছি আমরাও সবাই পানিবন্দি হয়ে পড়বে। এই অবস্থায় থাকলে এই অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়বে।’  

এ ব্যাপারে ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘কোনও রাস্তা নেই, অথচ তমুব্রু খালে ঘন ঘন পিলার বসিয়ে একটি ব্রিজ নির্মাণ করছে মিয়ানমার। এটি মিয়ানমারের ভেতরে হলেও তমব্রু খালটির অধিকাংশ বাংলাদেশ অংশে। এই বাঁধের কারণে আগামী বর্ষায় পুরো গ্রামটি পানিবন্দি হয়ে পড়বে। এমনকি আমার নিজের বাড়িও থাকবে না।’

এ ব্যাপারে জানতে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি-এর অধিনায়ক লে.কর্নেল মন্জুরুল হাসান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘তমব্রু খালে নতুন করে ব্রিজ নির্মাণের বিষয়টি ইতোমধ্যেই আমি জেনেছি। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।’

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর সহিংসতার পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তবে কিছু রোহিঙ্গা সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে আটকা পড়ে এবং সেখানেই আশ্রয় শিবির তৈরি করে অবস্থান নেয়। ওই বছরে নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্ত পয়েন্টে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সরকার নো-ম্যানস ল্যান্ড থেকে সরিয়ে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডের অন্তত আরও ৫ হাজার রোহিঙ্গা এখনও অবস্থান করছে। কিন্তু মিয়ানামার সরকার নো-ম্যানস ল্যান্ডের এই ভূমি তাদের দাবি করে সেখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছে তাদের এবং একই সঙ্গে নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা সরে না গিয়ে এই নো-ম্যানস ল্যান্ডেই অবস্থান করছে। এসব রোহিঙ্গাদের বর্তমানে চিকিৎসাসহ মানবিক সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ স্থানীয় প্রশাসন, বিজিবি, রেডক্রস ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।