প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে চলছে জোর প্রস্তুতি, চলছে দফায় দফায় বৈঠক

স্বদেশ ফিরতে নানান শর্ত জুড়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গারা

নুরুল করিম রাসেল, টেকনাফ :

শর্তের মধ্যেই রয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। স্বদেশ ফিরতে নানান শর্ত জুড়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কেউ কেউ বিনা শর্তে ফিরতে চাইলেও কতিপয় রোহিঙ্গা নেতাদের তোপের মুখে সহজে মুখ খুলতে চাইছেনা ফিরতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গারা। সরেজমিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিজ জম্মভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরতে প্রস্তুত রয়েছে তারা। তবে নাগরিকত্ব প্রদান, নিজ ভিটে-জমি ফিরিয়ে দেওয়া, মিয়ানমারে আটককৃতদের মুক্তি, হত্যা, গনধর্ষন ও বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগের বিচারসহ তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিলেই ফিরে যাবে এমন অভিমত রোহিঙ্গাদের।

আগামী ২২ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে আনুষ্ঠানিকভাবে তিন হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গার স্বদেশ ফেরত যাওয়ার কথা রয়েছে। টেকনাফের ক্যাম্প ২৩, ২৪, ২৬ ও ২৭ প্রত্যাবাসনের এই তালিকা চুড়ান্ত করা হয়েছে। প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার ও টেকনাফে কার্য্যক্রম এগিয়ে চলছে।

সোমবার (১৯ আগস্ট) ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি, ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি), এনজিও কর্মকর্তা ও রোহিঙ্গা মাঝিদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে ক্যাম্প-২৬ (শালবন)এ। তবে প্রত্যাবাসনের তালিকায় কারা বা কে কে রয়েছেন তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি এবং তাদের নামও জানা যায়নি। এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত প্রত্যাবাসনে আগ্রহীদের তালিকা গোপন রাখা হয়েছে। টেকনাফ কেরুনতলী প্রত্যাবাসন ঘাট ও নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা শিবির পরির্দশন এবং সেখানকার রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এখানকার রোহিঙ্গা নেতা মো. জাকারিয়া জানান, সোমবার (১৯ আগস্ট) দুপুরের আগেই তিনটি বৈঠক করেছেন ইউএনএইচসিআর, সিআইসি ও অন্যান্য এনজিওদের সাথে। ওখানে প্রত্যাবাসনের বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। তবে কারা প্রত্যাবাসনের তালিকায় রয়েছেন জানাননি। স্বেচ্ছায় যারা মিয়ানমারে যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রত্যাবাস করা হবে। জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না বলে কর্মকর্তারা আশ্বস্থ করেছেন।

তিনি আরো বলেন, তাদের পক্ষ থেকে পুনরায় তাদের ন্যায্য অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এরমধ্যে নাগরিকত্ব প্রদান, নিজ ভিটে জমি ফিরিয়ে দেওয়া, মিয়ানমারে আটককৃতদের মুক্তি, হত্যা, গনধর্ষন ও বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগের বিচারের দাবী রয়েছে। এসব দাবী পুরণ হলে স্বেচ্ছায় এসময় টেকনাফের সদর ইউনিয়নের কেরণতলী প্রত্যাবাসন ঘাটে কয়েকজন শ্রমিক কাজ করতে দেখা গেছে। এসময় প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা একটি দল প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থান ও কক্ষ ঘুরে দেখেন।

সেখানে কথা হয় শ্রমিক ছৈয়দ নুর ও মোহাম্মদ কলিম বলেন, এখান থেকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা রয়েছে। ফলে ক্যা¤প ইনচার্জের নির্দেশে গত কয়েকদিন প্রত্যাবাসন ঘাটে নতুন করে পরিস্কার-পরিচ্ছনতা কাজ করছি। এছাড়া প্রতিদিন অফিসের লোকজন এসে তদারকি দায়িত্বপালন করছেন।

প্রত্যাবাসন ঘাটে দায়িত্বরত ১৬ আনসার ব্যাটালিয়নের হাবিলদার মোহাম্মদ আইনুল হক বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঘাটে কয়েকদিন ধরে কাজ চলছে। তাদেরকে আমরা সহযোগিতা করছি। শুনেছি কয়েকদিনের মধ্যে এই ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে। এর মধ্যে টেকনাফের প্রত্যাবাসন ঘাটে প্যারাবনের ভেতর দিয়ে লম্বা কাঠের জেটি, ৩৩ আধা সেমি-টিনের থাকার ঘর, চারটি শৌচাগার রয়েছে। সেখানে ১৬ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যা¤পের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।

একইদিন নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২৬ সিআইসি কার্যালয়ের পাশে ছোট ছোট ঘর করতে দেখা গেছে। যারা স্বেচ্ছায় যাবে, তাদেরকে এসব ঘরে রাখা হবে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ক্যাম্প ইনচার্জের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এসব লিফলেট বার্মিজ ভাষায় লিখা রয়েছে। লিফলেট সমূহে প্রত্যাবসনের পর এনভিসি কার্ডের মাধ্যমে ছয় মাস পরে নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের কথা বলা রয়েছে জানান রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা নেতা মোঃ জাকারিয়া জানান, সোমবার (১৯ আগস্ট) দুপুরের আগেই তিনটি বৈঠক করেছেন ইউএনএইচসিআর, সিআইসি ও অন্যান্য এনজিওদের সাথে। ওখানে প্রত্যাবাসনের বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। তবে কারা প্রত্যাবাসনের তালিকায় রয়েছেন জানাইনি। স্বেচ্ছায় যারা মিয়ানমারে যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রত্যাবাস করা হবে। জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না বলে কর্মকর্তারা আশ্বস্থ করেছেন।

ক্যাম্প ২৭ এর চেয়ারম্যান আব্দু রহমান বলেন বশর বলেন, নিজ জন্মভূমিতে ফেরত যাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। হঠাৎ করে বলা নেই, বার্তা নেই প্রত্যাবাসনের বার্তা পেয়ে আমরা হতাশ ও ক্ষুব্দ। একই ক্যাম্পের ব্লক এ’র মাঝি মোঃ নুর বলেন, সিআইসি ক্যাম্পের আশেপাশে কিছু ঘর তৈরী করা হয়েছে। যারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে তাদেরকে এ ঘরে রাখানো হবে। সেখান থেকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। মিয়ানমার সরকার ওখানেও ক্যাম্পে রেখে তদন্ত সাপেক্ষে কোথায় রাখবে সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্ত কিন্তু সিদ্ধান্ত এসব এখনো কেউ জানেনা। কিন্তু এতদিন ধরে আমরা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) কার্ডের বিপক্ষে ছিলাম। এখন প্রত্যাবসন কবরার সময় এনভিসি কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হবে। এটা রোহিঙ্গারা মেনে নেবেনা। এভাবে কোনো রোহিঙ্গা ফেরত যাবে বলে এই মাঝির মনে হয়না।এভাবে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে আমাদের মত থাকতে পারেনা।

নয়াপাড়া শালবাগান ক্যাম্পের (নং-২৬) রোহিঙ্গা হেড মাঝি বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমারের এক প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা শিবিরে পরিদর্শনে এসেছিলেন। তাদের সাথে আমাদের কথা হয়। আমরা ৪ টি শর্ত ছুড়ে দিয়ে ছিলাম। এ ছাড়া আমাদের সাথে ডায়ালগ করার কথা রয়েছে। এসব বিষয় সম্পন্ন না হতে রোহিঙ্গারা ফিরবেনা বলেও জানান তিনি।
একাধিক রোহিঙ্গা নেতা ও সাধারণ রোহিঙ্গারা জানান, তাদের পক্ষ থেকে পুনরায় তাদের ন্যায্য অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এরমধ্যে নাগরিকত্ব প্রদান, নিজ ভিটে জমি ফিরিয়ে দেওয়া, মিয়ানমারে আটককৃতদের মুক্তি, হত্যা, গনধর্ষন ও বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগের বিচারের দাবী রয়েছে। এসব দাবী পুরণ হলে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরবে রোহিঙ্গারা।

দেশ বিদেশ থেকে প্রত্যাবসন বিরোধী একটি চক্র (কতিপয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও সরকারি বিরোধী পক্ষ) ভয়েস কল ও অনলাইন রেডিওর মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচচালনা করছে বলে জানা গেছে। এমনি একটি অডিও বার্তা এক এনজিওর কর্মকর্তার কাছে রয়েছে। সেখানে জানা যায়,, রোহিঙ্গাদের পত্যাবাসন বিরোধী নানা কথা বলতে শুনা গেছে।

টেকনাফ নয়াপাড়া শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প (নং- ২৬) এর ইনচার্জ মোঃ খালিদ হোসেন জানান, প্রত্যাবাসনে জন্য ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের তালিকা হাতে পেয়েছি। পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবে প্রায় প্রস্তুতের কথাও জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে বার্তা পৌঁছানো হয়েছে। যাদের কাছে বার্তা পৌঁছেনি তাদেরকে মঙ্গলবারের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। এজন্য এনজিও কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা মাঝিদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রত্যাবাসনের বিষয়সহ ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোাচনা হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো জানান, কোন রোহিঙ্গাকে জোর পূর্বক প্রত্যাবাসন করা হবে না। ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

টেকনাফ উপজেরা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য স্ব স্ব ক্যাম্পের ইনচার্জ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যাবাসনের জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। তবে এমুহুর্তে কতজনকে প্রত্যাবাসন করা যাবে তা বলা যাচ্ছেনা।
উল্লেখ্য গত বছরের ১৫ নভেম্বর নির্ধারিত সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায় নি।