২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিধায় রোহিঙ্গারা, মহাচিন্তায় এনজিওরা!

ফাইল ছবি

ডেস্ক রিপোর্ট – কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার ৩৪টি শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা।রাখাইনে অভাবনীয় অত্যাচার ও সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তারা এই শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে অত্যন্ত কষ্ট করে নিম্নমানের জীবনযাপন করছে। দেশি-বিদেশি নানা সহায়তা ঠিকই আসছে, তবে তা এই বিশাল শরণার্থী শিবিরের জন্য যথেষ্ট নয়।এ কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই নিজ দেশে আবার ফেরত যেতে চায়, যেখানে তাদের উপর আর কোনো অত্যাচার করা হবে না এবং যেখানে তাদের নিজস্ব জাতীয় ও সামাজিক পরিচয় থাকবে।

তবে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক হলেও কিছু বিভ্রান্তিমূলক ধারণা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিঘ্নিত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে দেশী-বিদেশী মহল।কক্সবাজারের শরনার্থী শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। আর ২২ আগস্ট যতই ঘনিয়ে আসছে ধিরে ধিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প।হঠাৎ প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গারাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। স্বদেশে ফেরা নিয়ে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের মুখে মুখে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।বিশেষ করে ২৫-২৬ ও ২৭ নং ক্যাম্পে অবস্থান করা তালিকাভূক্ত ৩,৫৪০ জন রোহিঙ্গা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কিছু দেশী-বিদেশি এনজিওর কর্তা ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে পর্দার আড়ালে থেকে তারা কলকাঠি নাড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।প্রতিবার রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক হলেও নিজেদের মোটা বেতনের চাকরি অব্যাহত রাখার স্বার্থে তথাকথিত কিছু এনজিও বিভ্রান্তিমূলক ধারণা রোহিঙ্গাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে ইতিমধ্যে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামতে শুরু করেছে।

উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইসমাইল (৫৫) বলেন, ‘প্রত্যাবাসন শুরু হোক, তা আমরা সবাই চাই। কিন্তু শর্ত আছে। প্রত্যাবাসনের আগে রোহিঙ্গাদের “নাগরিক” হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে মিয়ানমারকে। তারপর রাখাইনে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের নিরাপত্তা দিতে হবে। তবেই রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে সিদ্ধান্ত নেবে।’

বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা সলিমা খাতুন (৩৪) জানান, ২০১৭ সালের নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যে সেখানকার সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে তাঁর স্বামীকে। ছোট এক বোনকে ধর্ষণ করেছে। আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে বসতি। এখন সেই বসতির কোনো চিহ্ন সেখানে নেই।

তিনি বলেন, ‘আমরা রাখাইনে গিয়ে আরেক শরণার্থী জীবন চাই না। নাগরিক স্বীকৃতি পেলেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেব।’

বালুখালী শিবিরের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি মিয়ানমারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে এসে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করেছে।

বৈঠকে আমরা সাফ জানিয়ে দিয়েছি, তিন দফা বাস্তবায়ন না হলে কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরে যাবে না।’ তাঁদের দাবিগুলো হচ্ছে—রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, রাখাইন রাজ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ ও ফেলে আসা বসতবাড়ি-সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে এবং কোনো আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে থাকতে রাজি হবে না।

টেকনাফের জাদিমোরা শালবন শিবিরের চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন হচ্ছে বলে শিবিরের ঘরে ঘরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু তিনিও জানেন না। জোর করে কাউকে ফেরত পাঠানো চেষ্টা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে বলে তিনি জানান।

এদিকে কক্সবাজারস্থ শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম জানিয়েছেন,বৈরি আবাহাওয়ার কারণে টেকনাফের কেরুতলীর নৌ-পথ বাতিল করে ২২ আগস্ট ঘুমধুমের মৈত্রী সেতু দিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

বাছাই করা ৩,৫৪০ জন রোহিঙ্গার তালিকা দেয়া হয়েছে তাদের অবস্থান ২৫-২৬ ও ২৭ নং ক্যাম্পে। সেখানেই ইউএনএইচসিআর তাদের মতামত নেবে। যারা স্বেচ্ছায় যেতে রাজি হয় তাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে আসা হবে।আর তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের বোঝানোর জন্য শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন এবং ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে কাজ করছে।

আর প্রত্যাবাসন হওয়া রোহিঙ্গাদের প্রথমে রাখাইনের রিসিভসন সেন্টারে যাবে। সেখান থেকে নব-নির্মিত ট্রানজিট ক্যাম্পে নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত,২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের পর মিয়ানমারের সাথে নানা আলোচনা সাপেক্ষে কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য একটি দিনও ধার্য করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ বাংলাদেশের সরকার এরকম একটি উদ্যোগ নেয় ঠিকই, কিন্তু রোহিঙ্গাদের আক্রোশ এবং অনাস্থায় সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, তারা নিজেদের বাসস্থানেই ফেরত যেতে চায়, কোনো ক্যাম্পে না। তারা এখনো আশংকা করছে যে, রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি এবং তারা ফেরত গেলে আবারো তাদের উপর অত্যাচার করা হবে। তাছাড়াও এখন পর্যন্ত যত অন্যায় তারা সহ্য করেছে সেজন্য তারা সবাই পূর্ণ বিচার দাবি করছে। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পর তাদের সাথে আবার সহিংস কর্মকান্ড কিংবা অত্যাচার সংগঠিত হবে না এমন নিশ্চয়তা ছাড়া তারা ফেরত যেতে অস্বীকৃত জানিয়েছে। একই দাবি ও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে আশংকা জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।