অদেখায় গেল বেলা!


আলমগীর মাহমুদ


কথাটারও বয়স হয়েছে। লম্বা বন্ধ আসছে আসছে।কলেজ ক্যান্টিনে গরম চা’র আড্ডায় ঘূর্ণিঝড় তুলেছে কলিগেরা।বেশ আবেগঘন পরিবেশ। ভাবলাম এমন পরিবেশে সব কিছুই গিলানো যাবে।

প্রস্তাব রাখি বন্ধে গ্রুপ ট্যুরের স্বাদ নিলে কেমন হয়? সাথে সাথেই একজন বেশ দরদহীন ভাষায় ভেংচি কেটে কইল ” আমরা গ্রুপ ট্যুরে গেলে এই ট্যুর কোটায় কি আমার ছেলের চাকরী হইবে? নাকি আমার বেতন বাড়বে?

এমন চিন্তার মানুষের সাথেই কেটেছে বেলা।পেট পূঁজায় গেল জীবন। শক্তিহীন সীলেবাস পড়াই।আমি না পড়ালেও গাইডের বদৌলতে পার পেয়ে যায়। ক্লাসে হাজিরা জরিমানা দেয় কচ কইচ্চা হাজারী নোট।দিলে মাফ। বিধান আছে।

রোয়াইঙ্গার চাকুরী কাম ছাত্রছাত্রী। সবাই এম,এ, বি,এ পাশ। সার্টিফিকেটও আছে।আবার ভর্তি, জ্ঞানের জন্য নয় ঝালাই করে কর্মের সার্টিফিকেটটারে বৈধ করন প্রক্রিয়া।

গাইডের সহযোগিতায় ফাষ্ট ক্লাস পায়,স্যার লায় না।মধ্যে মধ্যে ভাবনা হয় যে সীলেবাস গাইডে ফাষ্টক্লাশ দিতে শক্তিধর, স্যারের প্রয়োজনই পড়ে না! সেখানে আমার দরকার কি ?

আমারে বেকার ভাতাই দেয়, বেতন নয়।যার ফলে মেঘে মেঘেই যায় আমার দেশের শিক্ষকদের দিনকাল।তাঁদের পেনশন পরবর্তী ডাক পড়ে না আন্তর্জাতিক সংস্থায়। অথচ অন্যান্য দেশে WFP / UNHCR /UNDP /UNICEF চেয়েই রয় কবে শিক্ষক পেনশনে যাচ্ছে।

ভাবলাম ঠিকে থাকাই নৈবেদ্য। ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন দিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বৈধ পেট পালন কর্মী বনলে আম, ছালা দুটোই রইবে ফকফইক্যা।

ভ্রমন বিষয়ের শিক্ষক হয়ে গেলাম ।বাড়তি দায়িত্ব ।ছাত্ররাও খুশী কতৃপক্ষও।এখন ছাত্ররা সার্টিফিকেট চায়, জ্ঞান নয়।শেখাতে গেলে,শাসন করতে গেলে হিতেবিপরীত অবস্থা।ছাত্রদের ভাবনা স্যারেরা আমাদের সাথে ভাল এনা থাকবে, শাসন করতে চায় কেন?

আমিও নিলাম বিশেষ কৌশল। যারাই আসে ঘুরতে চায় তাদের ফেরত করি না।সেদিন উপজাতির উখিয়া কলেজে পড়ুয়ারা ছেকে ধরে। আপনাকে আমাদের সাথে যেতেই হবে।স্থান মঞ্জয় পাড়া বরইতলী ঝর্ণা। ঘুংধুম নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান।

হলদিয়া পাতাবাড়ির নলবনিয়া এলাকায় আমার নানার বাড়ি।ছাত্ররা যে স্থানটির কথা বলেছে ছোট বয়সে নানার বাড়িতে গেলে এলাকাটির চাটগাঁইয়া ঢং এ শুনতাম “চাম্মা পারা”(চাকমা)।গরু,মহিষ চরানীর লোকজনের বাস। তারা সারা বছর জুম চাষ করে, ফসলাদি ফলায় ।

ভুলেও ভাল, সভ্য মানুষ পা মাড়ায় না। তারা চাম্মা পাড়া বেড়াবে?চাম্মা পাড়ায় শিক্ষাসফর! কেমন বেমানান বেমানান মনে হইল, সামান্য হাসিও…চাম্মা পাড়া ভ্রমন!

করলাম আয়োজন । গাড়ির যাত্রা শেষ, এরপর হাঁটা পথ। কলাপাতার মোচা আছে সাথী।হাঁটছি,দেখছি, বিমোহিত হচ্ছি। মনের ভাবনা চাম্মা পাড়ায় এই সুন্দর! তিন ঘন্টা হাঁটার পর রংধনু ঝর্ণায় পৌঁছালাম।

 

সবাই ঝর্ণা ধারায়। পানি যেখানে পড়ছে রংধনুর সাত রং জ্যোতি ছড়াচ্ছে। পলাশ আরেকবার দেখিয়ে কয় “অ স্যার চাম্মা পাড়া একি দেখির! বিহ্বল হলাম। ঝর্ণার পানি পড়তেই সাত রংয়ের রংধনুর রং স্পষ্ট।অবাক অবাক অবস্থা !

দ্বিতীয় ঝর্ণার শোভা ছিল প্রথমটার বিপরীত। আমরা পাহাড়ের চূঁড়ায় উঠে জলধারায় এলিয়ে দিলাম দেহ।মন ভরে গেল।

এরপর তৃতীয় ঝর্ণায় সবাই গোসল সেরে পাঠাতনের মত সীলের পাহাড়। জল গড়িয়ে পড়ছে। ওখানে বসেই জলধারার মিতালীতে খেয়ে অনুভূতি প্রকাশ অনুষ্ঠান।

সীমারেখার বাইরে বয়ে গেল বেলা। ফিরতি যাত্রা শুরু। ফেরার পথে পথে মনের ভাবনা ” অ..চাকমা পাড়া তুই ত ‘চাম্মা পারা” সন্মান ছাড়া পাড়াই ভেবেছিলাম সারাটা জীবন।তোর এখানে চাষীর গরু মহিষ চরানী খোলা আছে। জুম চাষের পাহাড়।কলা,লেবু,আনারস, জোয়ারী, কাল বিনি চাউল,মারবা,গুনছি গুলা,বন মোরগ পাহাড়ি ভেজালমুক্ত খাবারে থোরুং এ করে মেয়েরা উৎপাদন করে বাজারে বিক্রিতে সংসার চালায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নির্বাহে দিন কাটায়।

এরা মগ, গরীব, অনাধুনিক,পশ্চাদপদ, শহুরে জীবনে কম বুদ্ধির মানুষ বেশে অতিথি পাখির মত মিলে দেখা ।এতপাশে আমাদের এই চাকমা পাড়া। নানার বাড়িতে শৈশব, কিশোর কাটল অথচ কোনদিনই শুনিনি তোর বুকে রং্ধনুর সাত রং খেলা করে আজন্মই। তরে ভেবেছি অবজ্ঞা, অবহেলার, আকর্ষণ হীনতার প্রকাশময় শব্দ “চাম্মা পারা এরি”!

ক’দিন আগেও উখিয়া জনপদে ‘চাম্মা পারা’ শিক্ষাসফর কইলে ভেংচিকেটে সর্বোচ্চ জোরে হাসত আর কইত নুতন পাগল।

সমালোচনায় কইত,” পাহাড়িরা” ‘পাহাড়’ থেকে কি আছে শিখার?

দেখে মনে ধরল, এখানকার পাথরী পাহাড় গুলোর গঠন বৈচিত্র্যতা এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়। যাহ ভূগোল বিষয়টির গবেষকদের মনের কথা বলতেই আছে অপেক্ষায়!

মাটি ও সবুজের বৈচিত্র্যতায় মৃত্তিকাবিজ্ঞানী, পরিবেশ বিজ্ঞানীদের হাতছানি দিয়ে যেন অনবরত গেয়েই চলেছে”

” আমি হৃদয়ের কথা বলিতে চাহি
কেউ শুধাইলনা মোরে..
কেউ শুধাইল না মোরে….!

লেখক: আলমগীর মাহমুদ

বিভাগীয় প্রধান-সমাজবিজ্ঞান বিভাগ।

উখিয়া কলেজ, কক্সবাজার।

ইমেইল – alamgir83cox@gmail.com