কক্সবাজারে শুটকী উৎপাদনের ধুম

বিশেষ প্রতিবেদক •

শুটকি মাছের সারি

দেশের বৃহত্তম শুটকী পল্লী কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকসহ জেলার সমুদ্র তীরবতী এলাকায় এখন পুরোদমে চলছে শুটকী উৎপাদন। সাগর থেকে ধরে আনা প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছ শুকিয়ে এখানে তৈরি করা হচ্ছে সুস্বাদু শুটকী। বর্তমানে কক্সবাজারে দৈনিক গড় উৎপাদন ৫শ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি বছর শীতকালে কক্সবাজার সমুদ্র উপকুলে সাগরের পানির উচ্চতা কমে গিয়ে সৈকতে বিশাল চর জেগে ওঠে। আর এসব মৌসুমী বালুচরে বাঁশের মাঁচা বানিয়ে সেখানে সামুদ্রিক মাছ শুকিয়ে শুটকী তৈরি করে স্থানীয় জেলেরা। তবে দেশের বৃহত্তম শুটকী পল্লী কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকে বর্ষাকাল ও সাগরে মাছ ধরার উপর নিষিদ্ধ সময় ছাড়া সারা বছরই শুটকী তৈরি করা হয়। আর গত প্রায় ২ মাস ধরে একটানা বৃষ্টিবিহীন চমৎকার আবহাওয়া থাকায় এখানে শুটকী উৎপাদনও হচ্ছে নির্বিঘ্নে। সেসাথে শীতকালীন পর্যটন মৌসুম উপলক্ষে কক্সবাজারে এখন পর্যটকের ভীড় থাকায় শুটকীর চাহিদাও ব্যাপক।

কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকের সমুদ্র তীরবর্তী বালুচরের প্রায় ১শ একর জমিতে গড়ে ওঠেছে দেশের বৃহত্তম শুটকী পল্লী। এখানে শুটকী উৎপাদন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। যারমধ্যে অধিকাংশই নারী শ্রমিক। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) নাজিরটেকসহ জেলার সমুদ্র তীরবর্তী বালুচরের জেলেপল্লীসমূহে শুটকী উৎপাদন চলে। তবে বৃষ্টি না থাকলে বছরের অন্যান্য সময়েও কিছু শুটকী উৎপাদন হয়। সাগরের বালিয়াড়িতে বিশেষ উপায়ে তৈরী করা বাঁশের মাচার উপর কাঁচামাছ বিছিয়ে সূর্যের তাপে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুটকি। কাঁচা মাছ সূর্যেরতাপে শুকিয়ে শুটকী হতে ৩/৪ দিন সময় লাগে।
এরপর উৎপাদিত শুটকিগুলো বস্তাবন্দী করে ট্রাকবোঝাই করে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্নস্থানে। শহরের নাজিরারটেক ছাড়াও মহেশখালী, সোনাদীয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়াসহ জেলার উপকুলীয় সৈকতে শুটকী শুকানো হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে নাজিরারটেক শুটকি মহালে মাছের গুঁড়াসহ ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদন হয়। যারবাজারমূল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা হয়। জেলার অন্যান্য এলাকাতেও নাজিরারটেকের প্রায় সমপরিমাণ শুটকী উৎপাদিত হয়।

জেলা মৎস্য কর্মকতা এএসএম খালেকুজ্জামান বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষজাতের ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুটকী উৎপাদন করা হয়। এখানে উৎপাদিত শুটকী শুধু কক্সবাজারে নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ সারাদেশের মানুষের চাহিদা মেঠাচ্ছে। এমনকি এখানে উৎপাদিত শুটকীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদার একটি বড় অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুটকী থেকে পূরন হচ্ছে।
নাজিরারটেক শুটকী মহালের ব্যবসায়ী মো. নুরুদ্দিন কোম্পানী জানান, এখানে রূপচাদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, পোপা, টেকচাঁদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা ও নাইল্যামাছসহ ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছের শুটকী তৈরি করা হয়। বর্ষাকালে টানা বৃষ্টির সময় ছাড়া বছরের ৬/৮ মাস এখানে শুটকী উৎপাদন চলে। আর ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত ভরমৌসুমে এখানে প্রতিদিন গড়ে দুইশত থেকে আড়াইশ মেট্রিক টন করে শুটকী উৎপাদিত হয়।

নাজিরারটেক শুটকী ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিকউল্লাহ কোম্পানী জানান, প্রায় একশ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা দেশের বৃহত্তম এ শুটকী মহালে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আড়ত রয়েছে। এখানে বিশ হাজার শ্রমিক ছাড়াও প্রায় দুই হাজার ব্যবসায়ী রয়েছেন।
তিনি বলেন, দেশের বৃহত্তম এ শুটকী মহাল থেকে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেলেও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া গুণতে হয় অতিরিক্ত। ফলে একদিকে উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে শুটকী উৎপাদনেও ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যার সম্মুখিন হতে হচ্ছে।

নাজিরারটেকসহ জেলার সমুদ্র উপক‚লীয় উন্মুক্ত বালুচরে সনাতনী পদ্ধতিতে শুটকী উৎপাদন হলেও সাম্প্রতিককালে গড়ে ওঠেছে আধুনিক শুটকী তৈরির কারখানাও। চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল প্রাপ্তীর নিশ্চয়তা থাকলে এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্প খাত হয়ে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞানীদের মতে, শুটকীতে সাধারণ মাছের তুলনায় তিনগুণ প্রোটিন রয়েছে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছে রয়েছে মেধা বৃদ্ধিকারক ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড। যে কারণে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে বিবেচিত শুটকী।