জয় করে গেলেন শহীদ জননী রত্নগর্ভা আলমাস খাতুন

তোফায়েল আহমদ :

১৯৬৭ সালে একদম অকালেই প্রাণ হারিয়েছিলেন শিক্ষাবিদ ছৈয়দ হোছাইন মাষ্টার। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে একে একে ৫১ টি বছর কিভাবেই যে কাটিয়ে দিলেন এই দুঃখীনি নারী-একমাত্র তিনিই জানেন। এতকাল তাঁর বুকে কি পরিমাণ যন্ত্রণা দানা বেঁধে ছিল সেটা অনুভব করার কথাও এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। অকালে স্বামী হারা এই নারীর বুকে পিঠে তখন ছিলেন নয়টি সন্তান।

একদিনের হতভাগি নারী তিল তিল করে মানুষ করেন ৯ সন্তানকে। এমনকি অঢেল ধন দৌলতের মালিক ছিলেন-এই মহিয়সী নারী ? আলাদীনের চেরাগ হাতে নিয়ে বসেছিলেন-তিনি ? কিভাবে এতগুলো সন্তানকে তিনি কোলে-পিঠে নিয়ে মানুষ করলেন ? শুনতেই অবাক হতে হয়।

স্বামী বেশ অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে যায় ঘরে যাই ছিল তা। মৃত্যুর সময় রেখে যান মাত্র ৭/৮ কানির মত জমি-জিরাত। থাকার ঘরটিও ছিল ভাঙ্গাচোরা। স্বামীর রেখে যাওয়া জায়গা-জমি উদ্ধার করতেই এই নারীকে রিতীমত সংগ্রামে নামতে হয়েছিল। তারপরেও তিনি ছিলেন অদম্য নারী। কিছুতেই পিছপা হবার পাত্রী নন তিনি। পা বাড়াবেন সামনে।
শেষ পর্যন্ত অদম্য এই নারীই হলেন একজন রতœগর্ভা মা। এই মায়ের নাম আলমাস খাতুন। শহীদ জননী আলমাস খাতুন। গতরাত (বৃহষ্পতিবার রাত) প্রায় ৮ টার সময় ৯৩ বছর বয়সে তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)।

রতœগর্ভা মা আলমাস খাতুন তাঁর জ্যেষ্ট সন্তানকে অকাতরে দান করে গেছেন দেশ মাতৃকার জন্য। তিনি শহীদ এটিএম জাফর আলম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধারণ মেধাবী ছাত্র শহীদ এটিএম জাফর আলম ছিলেন পুর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ হন প্রয়াত আলমাস খাতুনের এই গর্বিত সন্তান। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই গর্বিত শহীদের নামেই উখিয়ার কোট বাজারে অনুষ্টিত ছাত্রলীগের সভায় দাবি উঠেছিল উখিয়া থানার নাম ‘শহীদ জাফরাবাদ থানা’ রাখার জন্য।

স্বামী হারানোর মাত্র ৪ টি বছরেরর মাথায় আলমাস খাতুন হারান তাঁর জ্যেষ্ট মেধাবী সন্তান জাফরকে। তারপরবর্তী সন্তান নুরুল আলম, ফরিদুল আলম, শামশুল আলম, মোহাম্মদ শফিউল আলম, মোহাম্মদ শাহ আলম, ছুরত আলম, জহুরুল আলম ও একমাত্র কন্যা রাবেয়াকে নিয়েই অদম্য নারী শহীদ জননী আলমাস খাতুন নতুন করে যাত্রা শুরু করেন।

এ যাত্রায় উঠে আসেন পঞ্চম সন্তান আরেক অসাধারণ মেধার অধিকারি মোহাম্মদ শফিউল আলম। মা আলমাস খাতুন তাঁর পঞ্চম সন্তানকেও তুলে দেন জাতির সেবায়। মেধাবী সন্তান মোহাম্মদ শফিউল আলম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসাবে এখন কর্মরত। গর্বিত এই মায়ের ষষ্ট সন্তান অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শাহ আলম হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।

সদ্য প্রয়াত মায়ের স্মৃতিচারণ করে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শাহ আলম গতরাতে বলেন-‘মা আমাদের কিভাবে মানুষ করেছেন সেটা এখন আর ভাবতে চাইনা। বাবার মৃত্যুর পর অথৈ সাগরে মা ভেসেছিলেন। তবুও মা কোন সময় ভেঙ্গে পড়েন নি। আমরা এতগুলো ভাইবোনকে কিভাবে লেখাপড়া শিখাবেন সেটাই ছিল তাঁর দিন-রাতের স্বপ্ন।’

অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির দখল পেতেও মাকে রিতীমত যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেই সম্পদ নিয়েই আমাদের জীবন-জীবিকা। জমিতে হাল দেয়ার জন্য মজুর রাখার টাকার অভাবে সকাল বেলায় আমরাই হাল দিতাম। জমি চাষ দিয়ে গোসল করারও সময় পেতামনা অনেক সময়। হালের জমি থেকে উঠেই বগলে বই নিয়ে ছুটতাম স্কুলে। মায়ের সেই দুঃখের দিনগুলোর কথা আমরা কিভাবে ভুলব ?

১৯৬৭ সালে যখন বাবা মারা যান তখন আমাদের কনিষ্ট একমাত্র বোন রাবেয়া ছিল ৬ মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশু। আজ রাবেয়াও পঞ্চাশোর্ধ। গতরাতে মা যখন না ফেরার দেশে চলে যান আমাদেরই বোনটা বার বার মোর্চা যাচ্ছিলেন-বলেন শাহ আলম চেয়ারম্যান। এই মা ইতিমধ্যে সফল জননী হিসাবে স্বীকৃতিও পেয়েছেন ২০১৩ সালে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় মরহুমা আলমাস খাতুনকে সফল জননী হিসাবে জয়িতা পুরষ্কার প্রদান করেন। সফল জননী-শহীদ জননী আলমাস খাতুন সত্যি জয় করে গেলেন অসাধ্যকেই। সেকালের দারিদ্রতাকে ডিঙ্গিয়ে অকুতোভয় এই নারী সমাজকে দেখিয়ে গেলেন-আমি জাতিকে দিয়েছি-আমি দিতে পেরেছি। আজ তিনি চিরশায়িত হবেন দীর্ঘ একান্ন বছর আগে যিনি চির বিদায় নিয়েছিলেন সেই জীবনসঙ্গীর কবরের পার্শ্বে-জয়তো শহীদ জননী আলমাস খাতুন।