ডেস্ক রিপোর্ট •
ভালোবাসার প্রদীপ প্রজ্জ্বালন করে লাকিংমে চাকমার ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চাওয়া হয়েছে। আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, এএলআরডি ও ব্লাস্টের যৌথ উদ্যোগে শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এই প্রদীপ প্রজ্জ্বালনের আয়োজন করা হয়।
প্রদীপ প্রজ্জ্বালনের আগে সংগঠনগুলোর পক্ষে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শিলখালি গ্রামের মেয়ে লাকিংমে চাকমাকে অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর এবং বিয়েতে বাধ্য করার ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করা হয়।
আলোচনা সভার শুরুতে সংগঠনগুলোর পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালেয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, লাকিংমেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মিথ্যা জন্মনিবন্ধন সনদে ধর্মান্তর এবং বাল্যবিয়েতে বাধ্য করার ফলে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটি একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। সন্তান জন্মের মাত্র ১৩ দিন পর মারা যায় সে। তার মৃত্যুটিও অস্বাভাবিক। অপহৃত লাকিংমে হত্যা, কিংবা আত্মহত্যার প্ররোচনার শিকার হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, লাকিংমে চাকমার লাশ মা-বাবার কাছে হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে মেয়েটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিল, ফলে বিয়েটি অবৈধ এবং তার প্রতি ধর্ষণের মতো অপরাধও হয়েছে। লিখিত বক্তব্যে উপস্থাপিত সাত দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- লাকিংমেকে জোর করে ধর্মান্তর, বিয়ে ধর্ষণ ও হত্যা কিংবা আত্মহত্যায় প্ররোচণার ঘটনায় নিয়মিত মামলা দায়ের, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার, সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা, লাকিংমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ক্ষতিপূরণ দেওয়া, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ, মামলা তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অবহেলার বিভাগীয় তদন্ত এবং লাকিংমের সন্তানকে আইনানুযায়ী রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নিয়ে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা।
সঞ্চালকের বক্তব্যে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহানাজ সুমী জানান, গত বছরের ৫ জানুয়ারি টেকনাফের বাহারছড়ার মাথাভাঙ্গা এলাকা থেকে লাকিংমে অপহৃত হয়। জন্মসনদ অনুযায়ী ওই সময় তার বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। ঘটনার পরপরই লাকিংমের বাবা লালাঅং চাকমা টেকনাফ থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন। পুলিশ মামলা না নেওয়ায় গত ২৭ জানুয়ারি লালাঅং তার মেয়েকে উদ্ধারে কপবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। গত ৯ ডিসেম্বর অপহরণের দায়ে অভিযুক্ত আতাউলল্গাহর ঘরে মারা যান লাকিংমে। পুলিশের মাধ্যমে খবর পেয়ে লাশ সৎকারের দাবি করেন লাকিংমের বাবা লালাঅং চাকমা। আতাউলল্গাহ অভিন্ন দাবি করলে আদালত র্যা বকে ধর্মপরিচয় নিশ্চিত হয়ে মরদেহ সৎকারের ব্যবস্থা এবং মামলাটির পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। লাকিংমের মরদেহ গত ৪ জানুয়ারি তার বাবাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে নিরাপত্তার কারণে ওই দিন লাকিংমেকে তার গ্রাম টেকনাফের শিলখালির পরিবর্তে রামুর কেন্দ্রীয় বৌদ্ধমন্দিরে সমাহিত করা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, টেকনাফের পরিবর্তে রামুতে লাশ সমাহিত করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে লাকিংমেদের গ্রামে তার স্বজনরা নিরাপত্তাহীনতা ভুগছে। র্যা বের প্রাথমিক তদন্তের পর লাকিংমের মরদেহ তার বাবাকে বুঝিয়ে দেওয়ার ঘটনায় আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। কিন্তু অপহরণ, ধর্মান্তর, বাল্যবিয়ে ও মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করার মতো কিছু এখনও হয়নি। বরং প্রশাসন চরম অবহেলা দেখিয়েছে। অবহেলা না হলে একটি মেয়ের প্রাণ অকালে ঝরে যেত না। আমরা পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দাবি করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, লাকিংমের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের কোনো কিছুই বাদ রাখা হয়নি। প্রতি রাতেই শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তার ধর্মও জোর করে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে। এমন নিষ্ঠুর ঘটনার বিচার চাই। আমরা এটা সহজে ছাড়তে রাজি নই, বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজপথেই থাকব।
লাকিংমের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রীনা রায় বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। লাকিংমে যে মেয়ে সন্তানটি জন্ম দিয়ে আমাদের কাছে রেখে গেছে, তার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
প্রদীপ প্রজ্জ্বালনে কপবাজার থেকে এসেছিলেন লাকিংমের বাবা লালাঅং চাকমার আইনজীবী মহিউদ্দিন খান। তিনি বলেন, লাকিংমে প্রথম থেকেই ন্যায়বিচার বঞ্চিত। আমরা ন্যায়বিচারের আশায় আছি। লাকিংমের ওপর ঘটে যাওয়া বর্বোরোচিত ঘটনার বিচার যতদিন হবে না, ততদিন আদালতে লড়ে যাব। আমি স্বেচ্ছাশ্রমে মামলাটি পরিচালনা করে আসছি। ভবিষ্যতে এই জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেব না।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-