রোদ -বৃষ্টি,শীতে কাবু হলেও স্বস্তি রোহিঙ্গাদের: জান-পরান লই বাংলাদেশে ভালাই আছি

শ.ম.গফুর,উখিয়া :
যা পাইছি, যেভাবে আছি তা শুকরিয়া,রোদ -বৃষ্টি আর শীতের মাঝে কষ্ট পেলেও দু:খ মনে করিনা।কারণ অন্তত জান- পরাঁন নিয়ে বেঁচে আছি এটাই শুকরিয়া।

কথা গুলো বলছিলেন মিয়ানমারের কেয়ারিং প্রাংয়ের বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ শামসুল নবী।সে বর্তমানে কুতুপালংয়ের ডি-৫ সংলগ্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা।শামসুল নবীর পরিবারে স্ত্রী, ২ ছেলে,এক পুত্র বধু,২ কন্যা নিয়ে ৭ জনের সংসার। শামসুল নবীর মত অনেকেই একই কথা ব্যক্ত করলেন।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গাদের সমস্যার শেষ নেই। তার মাঝেও স্বস্থি আছে রোহিঙ্গাদের। অন্তত জান-পরাঁন নিয়ে বেঁচে থাকায়।প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার মৌলিক অধিকার পূরণই দায়। চাল-ডাল থাকলে চুলা নেই, চুলা থাকলে লাকড়ি নেই। হাজারো সমস্যা তাদের। রোদ, বৃষ্টি বা শীত সব ঋতুতেই যেন বেমানান তারা। শীত মৌসুমে যেমন একটু বেশি ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে পড়েন রোহিঙ্গারা। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা শিশু ও বৃদ্ধ মারা যান। একইভাবে বর্ষা মৌসুম আসায় এখন নানা রোগে আক্রান্ত রোহিঙ্গারা। প্রায় অর্ধলাখ গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকিতে। তারা না পাচ্ছেন পুষ্টিকর খাবার, না পাচ্ছেন ঠিকমতো চিকিৎসা আর সেবা। এর মধ্যে আরও বড় আকার ধারণ করেছে বিপুলসংখ্যক শিশুর খতনা জটিলতা। সরকারি-বেসরকারিভাবে খতনা-সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। এতে শিশুরাও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

গতকাল কক্সবাজারের কুতুপালং, বালুখালী ও বান্দরবানের ঘুমধুম ও তুমব্রু এলাকায় বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এ সমস্যার কথা জানা গেছে।

কুতুপালং ও বালুখালীতে বেশ কয়েকটি ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের বড় অংশই এখন নানা রোগে আক্রান্ত। গর্ভবতী নারীরাও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হুমকিতে। মেডিকেল ক্যাম্পগুলোর সামনে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। খাবারের তেমন কোনো সমস্যা না হলেও লাকড়ি আর সুপেয় পানির চরম অভাবে রোহিঙ্গারা।

এ ছাড়া প্রায় ১৩ মাসে রিংয়ের ল্যাট্রিন ভরে যাওয়ায় এখন অনেকেই খোলা আকাশের নিচে কিংবা বনে-জঙ্গলে পায়খানা করছে।

জানা যায়, কাজ না থাকার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিসহ (নেতা) পরিবারের সদস্যরা নানা অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে খুনোখুনির মতোও ঘটনা ঘটছে।

মাস দুয়েক আগে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আরিফ উল্লাহ মাঝি নামে এক রোহিঙ্গা খুনের শিকার হন। এ ছাড়া কেউ কেউ মাদকসহ অসামাজিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ অস্ত্র নিয়েও ঘোরাফেরা করে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের চিত্তবিনোদন ও কাজের সুযোগ করে না দিলে তারা ব্যাপকভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে। একই সঙ্গে সন্তান জন্মদানের প্রবণতাও বাড়বে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবা দিতে সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রায় দেড় শ অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি নানা ওষুধপত্র বিনামূল্যে বিতরণ করছে এসব মেডিকেল ক্যাম্প।

ক্যাম্পগুলোর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ডব্লিউএইচপি, ডব্লিউএইচও, ইউএনএইচসিআর, আইওএম, রেডক্রস, রেড ক্রিসেন্ট, কাতার চ্যারিটি, সেভ দ্য চিলড্রেন, মালয়েশিয়ান ফিল্ড হাসপাতাল, হ্যানরি ক্যাপ, হোপ, এমএসএফ, ব্র্যাক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, মা-শিশু স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, জিপি হেলথ প্রভৃতি। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন সেবা সংস্থাও শুরু থেকে কাজ করে যাচ্ছে।

ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) পরিচালিত অস্থায়ী ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, মা-শিশু স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে দেখা গেছে নারী ও শিশুদের দীর্ঘ লাইন। কর্তব্যরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, তারা প্রায় ১০ মাস ধরে রোহিঙ্গা নারী-পূরুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আগত রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখের বেশী রোহিঙ্গা রোগীকে তারা প্রাথমিক সেবা দিয়েছেন বলে রেজিস্টার খাতা থেকে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে রোগীদের অবস্থা কী—জানতে চাইলে কর্তব্যরত এক চিকিৎসক বলেন, বর্ষা মৌসুম শুরু থেকে সর্দি, জ্বর, ডায়রিয়া ও আমাশয়ে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি ছিল। লিপি ওসুরমা নামে দুই স্বাস্ব্যকর্মী বলেন, তিনি প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ জন গর্ভবতী মাকে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে ডেলিভারিরও সুব্যবস্থা রয়েছে বলে তিনি জানান।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রথম দিকে প্রতিদিন গড়ে ছয়-সাত হাজার রোহিঙ্গা রোগীর সেবা দিতেন তারা। এখন তা অনেকাংশে কমে আসছে। ঢাকা থেকে আসা চারজন চিকিৎসকসহ ২০ জন স্বাস্থ্যকর্মী এখানে কাজ করছেন বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের সূত্রমতে, এরই মধ্যে তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ৪৮ হাজার গর্ভবতী নারী শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তৎমধ্যে অন্তত অর্ধেকের সন্তান প্রসব হয়েছে।এ ছাড়া প্রায় ২ শত জন এইচআইভি রোগীও শনাক্ত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ওই মেডিকেল ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আগস্ট মাসের শেষ দিকে যখন রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করে, তখন তাদের অনেকেই ছিল অর্ধাহারে-অনাহারে মৃতপ্রায়। অনেকেই ছিল বুলেটবিদ্ধ। বিশালসংখ্যক নারী ও শিশুরা ছিল নিস্তেজ। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের গুরুত্ব অনুধাবন করে বালুখালী পানবাজার এলাকায় ছোট্ট পরিসরে আমরা ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের যাত্রা শুরু করি। বালুখালীতে আমাদের এক বছর পূর্তি হয়েছে। রোহিঙ্গা রোগীদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আমরা জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে গর্ভবতী নারীদের ডেলিভারির ব্যবস্থাও করেছি। এখনো প্রতিদিন শত শত রোগীর দীর্ঘ লাইন হয়। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নানা প্রতিকূল পরিবেশেও সেবকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।’ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানালেন নানা সমস্যার কথা।

মিয়ানমারের মংডু থেকে আসা নুরহাবা নামে এক রোহিঙ্গা নারী স্বপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন বালুখালী ক্যাম্পে।তার সঙ্গে কথা হয় । তিনি জানালেন, চাল-ডালসহ সামান্য খাবার পেলেও তারা ঘরে থাকতে পারছেন না। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিতে ঘর কর্দমাক্ত। নিচে পলিথিন বিছানো হলেও তা ফুটো হয়ে পানি বের হয়। তার দুই বাচ্চার ডায়রিয়া হয়েছে। চিকিৎসাসেবাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। লাকড়ির অভাবে চুলাও জ্বলছে না। অনেক দূর থেকে কাঠ কেনা গেলেও টাকার অভাবে যেতে পারছেন না।

আয়াজ নামে এক যুবক জানালেন, বর্ষার পানিতে তাদের ল্যাট্রিন ভরে গেছে। এখন তাদের পরিবারের সদস্যরা ঠিকমতো ল্যাট্রিনেও যেতে পারেন না। বাচ্চারাও সব সময় কান্নাকাটি করে। সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত তার পরিবারের সদস্যরা।

হামিদ আলী নামে এক বয়স্ক রোহিঙ্গা জানালেন, বালুখালীর ময়নারঘোনা ক্যাম্পে অধিকাংশ টিউব অয়েলই এখন অকেজো হয়ে পড়েছে, যার কারণে এ ক্যাম্পে সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। যে কয়টি সচল আছে সেখানে লম্বা লাইন। সুপেয় পানির অভাবে তার পরিবারের ৪ সদস্য ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ ছাড়া দুই বাচ্চা নানা জৃীবানু আক্রান্ত বলে জানান তিনি।

এসব থেকে উত্তরণে স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও সংস্থা ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা জানালেন সংশ্লিষ্টরা।