অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিপাকে কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের কাজ

ভোরের কাগজ •

প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের কাজও আটকে আছে এ কালুরঘাট সেতুর জন্য। এ সেতুর ওপর দিয়েই চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারমুখী রেল চলাচলেরও আয়োজন চলছে। দোহাজারী-ঘুমধুম রেল লাইন নির্মাণের কাজ এরই মধ্যে ৬২ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। কিন্তু জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতুর কারণে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন রেললাইন প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা।

উচ্চতা জটিলতায় বারবার আটকে যাচ্ছে চট্টগ্রামে কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাজ। ফলে এ সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহন ও জনসাধারণের ভোগান্তি যেমন শেষ হচ্ছে না, তেমনি চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ ও ট্রেন চলাচলও অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কালুরঘাট সেতুটি যুগোপযোগী করে নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন, বাজেটও বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ সব পক্ষের মতামত না নিয়ে সেতু নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন করে নির্মাণাধীন সেতুর উচ্চতা নিয়ে আপত্তি তোলায় আবার নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাই করে তবেই নতুন করে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করতে হবে। এমনটাই জানা গেছে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনসহ সংশ্লিষ্টদের সূত্রে। অর্থাৎ ঠিক কবে নাগাদ স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণ হবে, সে বিষয়টি অনিশ্চিত।তাই পুরনো সেতুটির সংস্কার কাজ করতে যাচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদী পার হওয়ার জন্য এটিই ছিল প্রথম সেতু। শুধু ট্রেন চলাচলের জন্য ১৯৩০ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেতুটি নির্মাণ করলেও ১৯৫৮ সালে সেতুটি সব ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ এর ওপর দিয়ে ট্রেনও যেমন চলাচল করছে, তেমনি অন্যান্য যানবাহনও চলাচল করতে পারছে। তবে যখন ট্রেন চলাচল করে তখন অন্যান্য যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু কর্ণফুলী নদীর ওপর স্থাপিত একটি পুরনো রেল ও সড়ক সেতু। প্রায় শত বছর আগে নির্মিত সেতুটি মেয়াদোত্তীর্ণ ও জরাজীর্ণ হওয়ায় অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। মহানগরীর একাংশ ছাড়াও বোলায়খালী, পটিয়া উপজেলাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের লাখো মানুষকে নিত্য দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এটি অনেক পুরনো খবর। দীর্ঘ এক যুগ ধরে নতুন রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের জন্য স্থানীয়রা আন্দোলন করছেন। এলাকার জনপ্রতিনিধিরা প্রতিশ্রæতি দেয়ার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা থাকার পরও কালুরঘাটের নতুন সেতু নির্মাণ কেন আটকে আছে? বহুল প্রতীক্ষিত সেই সেতু নির্মাণে আর কত সময় লাগবে?

সরজমিন দেখা গেছে, ২ হাজার ১০০ ফুট দীর্ঘ সেতুর প্রায় পুরোটাই গর্তে ভরা। ভেঙে গেছে সেতুর দুই পাশের ডেক ও লোহার প্রাচীর। গর্তে যানবাহনের চাকা আটকে নিত্য যানজট হচ্ছে একমুখী এই সেতুতে। জরাজীর্ণ এই সেতুর কারণে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ওই অঞ্চলের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জোড়াতালি দিয়ে সেতুটি সচল রাখা হচ্ছে। ৯২ বছর আগে ১৯৩০ সালে ট্রেন চলাচলের জন্য সেতুটি চালু করা হয়। পরে ১৯৫৮ সালে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয় সেতুটি। এতে রয়েছে ছয়টি ব্রিক পিলার, ১২টি স্টিলের পিলার ও ১৯টি স্প্যান। একমুখী সেতুটিতে ট্রেনের পাশাপাশি গণপরিবহন ও পণ্যপরিবহনসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই কালুরঘাট সেতুর উপর গত তিন দশকে যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এ সেতু দিয়ে চলাচল করছে। সেতুর এক পাশে গাড়ি উঠলে অন্য পাশ বন্ধ থাকে। ফলে নিত্য দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি। যানবাহনের চাপে দুলতে থাকে সেতুটি। ঝুঁকি নিয়েই চলছে যানবাহন। যে কোনো সময় কালুরঘাট সেতুতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

তবে গত ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সফরে এসে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন কালুরঘাট সেতু প্রসঙ্গে বলেন, ‘নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণে ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। বর্তমানে সেখানে যে রেলসেতু আছে সেটার উচ্চতা ৪ দশমিক ৬ মিটার। নতুন যে সেতুর কথা বলা হচ্ছে, নেভিগেশনের কারণে সেটার উচ্চতা হতে হবে ১২ দশমিক ২ মিটার। আগের থেকে রেললাইন উপরে তুলে তারপর করতে হবে। আমরা চাই যে, সেতু করার পর যেন কোনো সমস্যা না হয়। সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েই নকশা তৈরির কাজ চলছে। এ কারণে একটু দেরি হচ্ছে। তবে অবশ্যই সেতু হবে। সেতুতে রেলেরও ডাবল লাইন থাকবে, সড়কেরও ডাবল লাইন থাকবে।’

কিন্তু রেলমন্ত্রীর এই ‘একটু দেরি’ যে ঠিক কত বছর, তা হয়তো তিনি নিজেও জানেন না। কারণ ফিজিবিলিটি স্টাডির রিপোর্ট, নতুন প্রকল্প গ্রহণ, একনেকে পাঠানো, পাস হওয়া, বাজেট বরাদ্দ, ঠিকাদার নিয়োগ- এসব করতেই লেগে যাবে দীর্ঘ সময়। তারপর সেতু নির্মাণের কাজ। সেই নির্মাণকাজ শেষ হতে ঠিক কত বছর লাগবে, তাও তো অনিশ্চিত বিষয়- এমনটাই বলছেন কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নে অন্দোলনকারী নেতা ও চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকরা।

নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণের দাবিতে চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার কয়েক বছর আগে সেতুটির পাশে দুই লেনের সড়ক কাম ডুয়েল-গেজ সিঙ্গেল ট্র্যাক রেল সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য প্রকল্পের ড্রইং-ডিজাইন, বাজেট এবং মেয়াদও নির্ধারণ করা হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে ১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণের চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের মার্চে কাজ শুরু করে ২০২৩ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথাও ছিল।

কিন্তু ২০১৮ সালে একনেক বৈঠকে নকশায় গলদ ধরা পড়ার পর কার্যত সেই উদ্যোগ থেমে যায়। রেল কর্তৃপক্ষের এই ডিজাইনে নদী থেকে সেতুর উচ্চতা ৭ দশমিক ৬ মিটার করলে তাতে আপত্তি জানায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। তারা নদী থেকে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার করার পরামর্শ দেয়। বর্তমানে নতুন করে ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। তবে এসব কাজ শেষ করে কবে নাগাদ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হবে, তা অনিশ্চিত। দীর্ঘদিন ধরে কালুরঘাট এলাকায় নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন স্থানীয় সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদলও।

এদিকে নতুন সেতু নির্মাণ কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ায় কালুরঘাট পুরাতন সেতু মেরামতের জন্য বুয়েটের দ্বারস্থ হয় রেলওয়ে। এ সেতুর ওপর দিয়েই কক্সবাজারমুখী ট্রেন চলাচল করবে। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান সেতুটি মেরামতের জন্য বুয়েটকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পেতে আবেদন করলে তাতে বুয়েট সাড়া দেয়। জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়ে বর্তমানে ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে দিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুয়েটকে দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে রেলওয়ে। এরই মধ্যে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পর্যবেক্ষক দলের প্রধান ড. এ এফ এম সাইফুল আমিন, অধ্যাপক ড. খান মাহমুদ আমানত ও ড. আব্দুল জব্বার খান কালুরঘাট সেতু পরিদর্শন করেন। বুয়েটের তিন সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ টিম সেতুর ত্রæটিগুলো চিহ্নিত করে গত ৪ ডিসেম্বর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আহসান জাবিরের কাছে পরিদর্শনের প্রতিবেদন জমা দেয়।

বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল বলেছে, যেহেতু এখনই নতুন সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়, তাই পুরনো এই সেতু দিয়ে কক্সবাজারের ট্রেন নিতে হলে সেতুটিকে সেই উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে সেতুটি সংস্কারের জন্য ১৯টি প্রস্তাবনা দেয়া হয়। তার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। কক্সবাজারগামী ট্রেন চলাচলের উপযোগী করতে কালুরঘাট পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের দিতে হবে ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বুয়েট প্রতিনিধি দলের সেই প্রস্তাব মেনেই কালুরঘাট সেতু উচ্চ গতির ট্রেন চলাচল উপযোগী করতে শিগগিরই টেন্ডার আহ্বানে যাচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণ চান্দগাঁও বোয়ালখালীসহ এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি। নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী সেতু নির্মাণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রথম নকশায় সেতুর উচ্চতা কিছুটা কম থাকায় দ্বিতীয়বারের মতো ফিজিবিলিটি স্টাডি ও নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। নকশা প্রণয়ন শেষ হলে খুব দ্রুত একনেকে প্রকল্পটি পাস করে এ বছরের মধ্যেই কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আহসান জাবির বলেন, কালুরঘাট নতুন সেতু নির্মাণে দাতা সংস্থার পরামর্শক দল আগামী মে মাসের মধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট এবং সেই সঙ্গে সংশোধিত নকশা আমাদের কাছে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। প্রতিবেদন পেলেই সেটি একনেক সভায় পেশ করা হবে। অন্যদিকে সেতুটি ঝুঁকিমুক্ত করতে মেরামতের জন্য বুয়েট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হবে। বুয়েটের পরার্শক দল যে সুপারিশ বা চাহিদা দিয়েছিল, সেটা আপাতত ফাইনাল হয়েছে। সেতু সংস্কারে শিগগিরই ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় টেন্ডার আহ্বান করব আমরা। টেন্ডার আহ্বানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সংস্কারের মাধ্যমে সেতুর সক্ষমতা বাড়ানো হবে।

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য সচিব রমেন দাশগুপ্ত বলেন, প্রায় শত বছরের পুরনো কালুরঘাট সেতুটি মেয়াদোত্তীর্ণ ও জরাজীর্ণ হওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে ওঠা সেতুটিতে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন সেতু নির্মাণের দাবিটি শুধু এই অঞ্চলের মানুষের নয়, সচেতন নাগরিকদেরও দাবি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে নতুন সেতুর দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু এই সেতু নির্মাণে এত বাধা কেন, তা বোয়ালখালীবাসী তথা দক্ষিণ চট্টলার জনমনে প্রশ্ন। একটি মাত্র সেতুই পাল্টে দিতে পারে বোয়ালখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামের চেহারা। অবিলম্বে কালুরঘাটে নতুন রেল কাম সড়ক সেতুর কাজ শুরু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী, রেলমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান তিনি।