আড়ালেই থেকে যাচ্ছে ইয়াবা ও হুন্ডির মূল গডফাদাররা!

আবদুল আজিজ, বাংলা ট্রিবিউন :

প্রতিকী ছবি

দেশে প্রথমবারের মতো আত্মসমর্পণ করলেন মাদক কারবারিদের একটি অংশ। টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ১০২ জন ইয়াবাকারবারি সাড়ে তিন লাখ ইয়াবা ও ৩০টি পিস্তলসহ আত্মসমর্পণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে। এর মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৫৭ জন শীর্ষ ইয়াবাকারবারি। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এখনও আড়ালে থেকে যাচ্ছে ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বড় অংশ।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা কয়েকজন ইয়াবাকারবারির বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, ‘ইয়াবা পাচার, অর্থ লেনদেনসহ নানা বিষয়ে অনেক বড় বড় গডফাদার রয়েছে। মূলত এরাই ইয়াবা পাচারের নেপথ্যে কাজ করছে। আত্মসমর্পণকারীরা জানায়, তাদের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি বলা হলেও নেপথ্যে একটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। যে চক্রের সদস্যদের কারও নাম এখনও প্রশাসন বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনও তালিকায় আসেনি। তারা নেপথ্যে অবস্থান করে এদের (আত্মসমর্পণকারী) দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।’

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ‘ইতোমধ্যে আত্মসমর্পণে আসা ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তিতে এমন ৩০ জন এজেন্টের নাম পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আর এ টাকা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার করা হয় দুবাই ও সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত ইয়াবার মূল মালিকদের কাছে। আর দুবাই সিঙ্গাপুর ঘুরে এ অর্থ পৌঁছানো হয় মিয়ানমারে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মনে করছেন, ইয়াবা গডফাদারদের নেপথ্যে রয়েছে টাকা সংগ্রহকারী হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। আর এসব হুন্ডি ব্যবসায়ীর নেপথ্যের ব্যক্তিরা রয়েছে দুবাই এবং সিঙ্গাপুর। ইতোমধ্যে দুবাই এবং সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া থেকেও কিছু ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করতে দেশে ফিরেছেন। ফলে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নেপথ্যের ব্যক্তিদের শনাক্ত করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে।’


আত্মসমর্পণ করা ইয়াবা কারবারিরা

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, টেকনাফের কোনও ব্যক্তির ইয়াবা ব্যবসায় জড়াতে বিনিয়োগ লাগে না। মিয়ানমার থেকে বিনামূল্যে ইয়াবার চালান পাঠানো হয় টেকনাফের নির্ধারিত ব্যক্তির কাছে। এই ইয়াবার চালান পাঠানোর সময় কোনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবা জব্দ হলে তার মূল্য পরিশোধ করতে হয় না। যে চালান নিরাপদে ব্যক্তিবিশেষের কাছে পৌঁছাবে কেবল তারই মূল্য পরিশোধ করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয় দেশের মধ্যে। মিয়ানমারে সরাসরি কোনও টাকা বা অর্থ পাঠাতে হয় না। দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত নির্ধারিত এজেন্টরা এ টাকা সংগ্রহ করে থাকেন। টেকনাফ, কক্সবাজার শহর, চট্টগ্রাম এবং ঢাকা কেন্দ্রিক এসব ব্যবসায়ী বৈধ ব্যবসার আড়ালে ইয়াবার অর্থ সংগ্রহ করে দুবাই-সিঙ্গাপুর পাচার করে থাকে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন টেকনাফের বহুল আলোচিত টিটি জাফর। এই টিটি জাফরের সিন্ডিকেটের ১০ সদস্য টেকনাফে অবস্থান করে নানাভাবে ইয়াবা অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন জালিয়াপাড়ার তাহের, আবদুল আলী, লেঙ্গা কামাল, সাইফুল, খোরশিদ। এছাড়া এই হুন্ডি চক্রের সদস্য জালিয়াপাড়ার ওসমান, ইসহাক, ইয়াছিন, গোদার বিলের টিক্কা কাদের, সাতকানিয়ার ওসমানের নামও এসেছে স্বীকারোক্তিতে। এর বাইরে  টেকনাফের লামারবাজারের একটি বেকারি, একটি কাপড়ের দোকান, কক্সবাজার শহরের ঝাউতলা এলাকার বিকাল এজেন্সের নামও পাওয়া গেছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানান, ‘ইয়াবাকারবারিরা আত্মসমর্পণ করার পর ইয়াবাবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হবে। যে কোনোভাবে এই দেশকে মাদকমুক্ত করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। যারা আত্মসমর্পণ করে নাই, মূলত আগামীতে অভিযানগুলোই তাদের জন্য। যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন কেউ রেহাই পাবে না।’

এদিকে বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন ইয়াবা সাম্রাজের আলোচিত ব্যক্তি সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি, তার ভাই কাউন্সিলর মৌলভি মুজিবুর রহমান, ইয়াবা ডন হাজী সাইফুল করিম, বাহারছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভি আজিজ উদ্দিন ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন, টেকনাফের নুরুল হক ভূট্টো, ছিদ্দিক আহমদ। এসব ইয়াবাকারবারিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় না আনা হলে আবারও ইয়াবা পাচার ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

উল্লেখ্য, গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় কক্সবাজার ও টেকনাফের ১১৫১ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম আসে। তারমধ্যে ৭৩ জন শীর্ষ মাদক কারবারী বা পৃষ্টপোষকের নাম আছে। তালিকার মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ তার পরিবারের ২৬ জন সদস্য রয়েছে। তাছাড়া টেকনাফ ও কক্সবাজার অঞ্চলের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের নাম আছে। এই তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিদের সম্পদের বিষয়টিও উঠে আছে।