‘একটি বড় মাছের দাম যত ইমাম মুয়াজ্জিনের মাসিক বেতন তত’

মাহাবুবুর রহমান :

কক্সবাজার শহরের কালুর দোকান বাজারে ৬ কেজি ওজনের সাগরের একটি কোরাল মাছ বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার টাকায়। এক ক্রেতা মাছের দরদাম করছে পাশে দাড়ানো এক মসজিদের ইমাম মন্তব্য করছেন এটা আমার এক মাসের বেতন,তাই এই মাছ কিনা আমার পক্ষে সম্ভবনা।

বাজার থেকে একটু বাইরে গিয়ে কক্সবাজার কলেজে মার্স্টাস পড়–য়া এক ছাত্র এক আইনজীবির বাসা থেকে টিউশনি করিয়ে আসছিলেন জানতে চাইতে সেই ছাত্র বলেন,মাসিক ৫ হাজার টাকায় ২ জন ছাত্র পড়াই এ সময় পাশে থাকা আরেক মসজিদের মুয়াজ্জিন বলেন,আমাদের ভাগ্য দেখেন সারা মাস চাকরী করেএত টাকা পায় না, আর উনারা দৈনিক দেড় ঘন্টা পড়িয়ে আমাদের চেয়ে বেশি পায়। এই চিত্র জেলার সব মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনের।

কক্সবাজার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে জেলায় মসজিদ আছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার,যেহেতু শহর পর্যায়ের মসজিদ গুলোতে ইমাম মুয়াজ্জিন থাকে কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে বেশির ভাগ মসজিদে একজনই সব দায়িত্ব পালন করে সে হিসাবে জেলায় ইমাম মুয়াজ্জিনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। কিন্তু এসব মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন খুবই কম। বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী চরম নূন্যতম পর্যায়ে চাকরী করছে জেলার বেশির ভাগ মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনরা।

খুরুশকুল তেতৈয়া এলাকার এক মসজিদের ইমাম নাম প্রকাশ না করে বলেন,সাধারণ মানুষের ধারনা আলেমদের কোন খরচ নাই,কিন্তু সমাজের আর দশজন মানুষের মত আমাদেরও যে পরিবার পরিজন আছে সেটা কেউ বুঝতে চায়না। এখনো আমাদের মাসিক বেতন সাড়ে ৪ হাজার টাকা,আর মুয়াজ্জিনের বেতন আড়াই হাজার টাকা।আপনারাই বলেন এই টাকা দিয়ে কোন মানুষ কি বর্তমানে চলতে পারে। তবুও সব মহান আল্লাহর রহমত আমরা সমাজে চলছি।

পিএমখালী ছনখোলা এলাকার একজন বলেন,মাসিক বেতন খুবই কম সেটাও আবার কমিটি ঠিকমত দিতে চায়না। আবার বেতন দেওয়ার সময় এমন ভাব করে মনে হয় উনারা অনেক কিছু করছে,তবুও আল্লাহর ইচ্ছায় সব কিছু ঠিকমত চলছে। তিনি বলেণ,সমাজে বা রাষ্ট্রের কোন কার্যক্রম আসলে প্রথমে আমাদের দিয়ে প্রচারণা বা অগ্রনি ভুমিকা রাখতে হয় কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে আমাদের কোন মূল্যায়ন নাই।

এ ব্যপারে টেকপাড়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম মৌলানা মোজাম্মেল হক বলেন,একটি এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যেমন অবদান রাখেন আমি মনে করি একজন ইমাম তার চেয়ে শতগুন বেশি সমাজের জন্য অবদান রাখেন।কিন্তু একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন ৩০ হাজার আর একজন ইমামের বেতন ৫ হাজার এই বৈষম্য দূর করা দরকার। আমি মনে করি সরকারি তহবিল থেকে ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন দেওয়া দরকার। একই সাথে ইমাম মুয়াজ্জিনদের সমাজ এবং রাষ্ট্রিয় কাজে কিভাবে আরো বেশি করে ব্যবহার করা যায় সে দিকে নজর বাড়াতে হবে।

ফোনে চকরিয়া শাহারবিল এলাকার  ইমাম মৌলানা নজরুল ইসলাম বলেন,শহরের অবস্থা কিছুটা হলেও ভাল কিন্তু গ্রামের অবস্থা খুব বেশি করুন। এখানে বেশির ভাগ মসজিদের সব দায়িত্ব একজনের পালন করতে হয় আবার মাস শেষে বেতনের জন্য গেলে উল্টো বলে বাকি দোকান ধরে মালামাল নিয়ে যান আমরা পরিশোধ করবো। আবার কোথাও মিলাদ বা দাওয়াত পেলে সেখানে কমিটিকে বলে যেতে হয়,কোন কারনে নামাজের বা আযানের সময়ে যথা সময়ে উপস্থিত হতে না পারলে মন্দ কথাবার্তা বলে কিন্তু এখন আমাদের বয়স শেষ কোথায় যাব তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে শত অপমান সহ্য করে রয়েগেছি। তবে শান্তি এটুকু এলাকার মানুষ খুব ভালবাসে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও জেলা সুজন সভাপতি প্রফেসর এমএ বারী বলেন,সাধারণত একজন আলেমকেই আমরা সমাজের আদর্শ মনে করি কিন্তু সমাজের সেই আদর্শ ব্যাক্তিটির আর্থিক স্বনির্ভরতা দরকার সেটা কেউ খেলায় রাখেনা। বরং কিছু অল্পশিক্ষিত লোক মসজিদ কমিটিতে গিয়ে আলেম সাহেবকেই নানান ভাবে হয়রানী করে। আমি মনে করি বাংলাদেশের এখন স্বক্ষমতা বেড়েছে সে দেশে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় একদিনের ষোষনায় সরকারি করতে পারে সেই দেশে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনদের বেতন ভাতা সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া তেমন কষ্ট হবে না। উদ্যোগ নিলে সব কিছু সম্ভব,প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু হলেও মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনকে রাষ্ট্রিয় ভাবে ভাতা দিতে শুরু করা দরকার।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার ইমাম সমিতির সভাপতি মৌলানা সিরাজুল ইসলাম ছিদ্দিকি বলেন,২৪ ঘন্টা সময় দিয়ে মাস শেষে এত কম বেতনে চাকরী করে বাংলাদেশে আর কোন পেশার মানুষ নেই। আলেমরা অনেক সিমাবদ্ধতার ভেতরে থাকে কিন্তু উনাদের মুখে হাসি কখনো মিলে যায় না। যদিও আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইমাম মুয়াজ্জিনদের জন্য বিশেষ প্রকল্প নিয়েছে এবং খুব শিঘ্রই সরকারি ভাবে ইমাম মুয়াজ্জিনরা সেই ভাতার আওতায় আসবে।

এ ব্যপারে কক্সবাজার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ পরিচালক ফাহমিদা বেগম বলেন,এটা সত্যিযে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনদের বেতন ভাতা খুবই কম। এই বেতনে কোন ভাবেই বর্তমান বাজারে চলা যাবেনা। আমার জানা মতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন সে জন্য তিনি নিজে এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও বিভিন্ন সভা সেমিনারে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন নিয়ে কথা বলেছেন। যতটুকু ধারনা করা হচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশের ইমাম মুয়াজ্জিনদের জন্য একটি বড় সুখবর আসতে পারে। আর বিভিন্ন এলাকার মসজিদ কমিটিতে যারা আছেন উনাদের ইমাম মুয়াজ্জিনদের যথাযত সম্মান করা দরকার।