ঐতিহাসিক ক্যাপ্টেন কক্স সাহেবের বাংলো

আনিস নাঈম, রামু :

ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। যার নামে কক্সবাজার জেলা নামের উৎপত্তি সেই মানুষটা এক সময় আশ্রয় নিতেন এই বাংলোতে। তিনি একজন ব্রিটিশ কূটনীতিক ছিলেন। তাকে এ অঞ্চলে শরণার্থী সমস্যা নিরসনের জন্য তৎকালীন পালংকির (বর্তমান কক্সবাজার) মহাপরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

দাপ্তরিক কাজ এবং আশ্রয়ের জন্য তখন এই বাংলো বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তিনি আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান পুরনো সংঘাত নিরসন ও শরণার্থী পুনর্বাসনের চেষ্টা করেন। কিন্তু কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ার আগেই ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে এই বাংলোতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, কক্সবাজারের প্রাচীন নাম পালংকি। হিরাম কক্স পালংকি এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি বাজার। প্রথমে বাজারটি ‘কক্স সাহেবের বাজার’ নামে পরিচিত ছিল।পর্যায়ক্রমে ‘কক্সবাজার’ নামের উৎপত্তি ঘটে। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের নামের সম্মানার্থে পরবর্তীতে এ সমগ্র জেলার নামকরণ করা হয়েছে কক্সবাজার জেলা।

দীর্ঘ যুগ ধরে অযন্ত অবহেলায় পড়ে থাকার ফলে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল ২২২ বছরের পুরনো বাংলোটি। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলো বাড়ির ইতিহাস তুলে ধরেন সংবাদকর্মীরা। এর আগে বাড়িটির ইতিহাস জানতেন না অনেকে। পরবর্তীতে কক্সবাজার জেলা ও বাইরের পর্যটকদের কাছে বাড়িটি আরও পরিচিত হয়ে ওঠে। তখন বাংলোর সংস্কার ও স্মৃতিফলক দেওয়ার দাবি তোলেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। যার ফলে নজরে আসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

বাংলোটি চলতি বছর নতুনভাবে সংস্কার করেন রামু উপজেলা প্রশাসন। আগে ‘জেলা পরিষদ বাংলো’ নামে পরিচিত থাকলেও এখন কক্স সাহেবের বাংলো হিসেবে পরিচিত।

বাংলো বাড়িটি রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের অফিসের চর এলাকায় অবস্থিত।কক্সবাজার শহর থেকে এটি ২৫ কিলোমিটার দূরে। সেখানে যেতে হলে প্রথমে পৌঁছাতে হবে রামু চৌমুহনী স্টেশনে।এরপরে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে রামু-মরিচ্যা আরাকান সড়কের পশ্চিম পাশে নজর পড়বে বাংলো বাড়িটি।

দেখা যায়, রাস্তার পাশ দিয়ে যেতেই সবার নজর কাড়ে ক্যাপ্টেন কক্সের ছবি সহ সাইনবোর্ডটি।ছবুজের ছায়ায় অসংখ্য গাছ-গাছালির মাঝেই বাড়িটি। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে বাইরে বসার জন্য রয়েছে দুটি সিট। বাড়িটির অভ্যন্তরে ঢুকতেই চোখে পড়ে স্মৃতিফলক। সেখানে ক্যাপ্টেন কক্স ও বাড়িটির ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এই বাংলোতে আছে ব্রিটিশ শাসনামলের একটি খাট, চেয়ার-টেবিল। রয়েছে রাত যাপনের সুযোগ।

বর্তমানে বাংলোটি সরকারি রেস্ট হাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কেউ রাত যাপন করতে চাইলে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য রাত প্রতি ২০০ টাকা ও পর্যটকদের জন্য ৪০০ টাকা দিতে হয়।

সেখানে দেখা যায়, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বাংলোটির দেখাশোনা করা বদিউল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে বাড়িটি কেউ দেখতে আসতো না। নামকরণ ও সংস্কারের পরে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। অনেকে রাত যাপন করছেন।’

চট্টগ্রাম থেকে ঘুরতে আসা সাফায়েত উল্লাহ, ইমন চৌধুরী, মেহেদী হাসানসহ কয়েকজন যুবক জানান, ইতিহাস জানতে আমাদের ঘুরতে আসা। এখানে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে তা উপলব্ধি করতে পেরেছি। নিস্তব্ধতা ও সবুজের ছায়ায় মন কাড়ে এই পরিবেশ। এ সময় তারা বাড়িটির সামনে সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন।’

স্থানীয় বাসিন্দা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক জুলফিকার আলি ভুট্টো বলেন, ‘এই বাংলোতে হিরাম কক্স দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেছিলেন। কিন্তু সেই ইতিহাস বেশির ভাগ লোকের কাছে অজানা ছিল। সবার দাবিতে নামকরণ করার ফলে এটি নতুন প্রজন্মের কাছে সুপরিচিত হয়ে থাকবে।’

রামুর ইউএনও ফাহমিদা মুস্তফা বলেন, ‘হিরাম কক্সের অবদানের সম্মানার্থে পর্যটন শহর কক্সবাজারের নামকরণ করা হয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের জনপদ রামু। বাংলোটির ইতিহাস সংরক্ষণে রামু উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংস্কার ও নামকরণ করা হয়। যা জেলার ইতিহাসে কালের সাক্ষী ও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে।’