দুশ্চিন্তায় মালিকরাও

কক্সবাজারের বিলাসবহুল বাসে মাদক

রিয়াদ তালুকদার •

ফাইল ছবি (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

পর্যটনের শহর কক্সবাজার থেকে রাজধানীসহ সারাদেশেই যাওয়া-আসা করে দূরপাল্লার বেশ কিছু বাস। অধিক মুনাফার প্রলোভনে মাদক চক্রের ফাঁদে পড়ছে এসব যাত্রীবাহী বাসের চালক, সহকারী ও সুপারভাইজাররা। এমনকি সম্প্রতি নামী অনেক কোম্পানির বাস থেকেও এমন মাদকের চালান উদ্ধার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

এসব ঘটনায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বাস-মালিকরাও। নিজেদের পরিবহনকে সুরক্ষিত রাখতে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সহায়তা কামনা করছেন তারা। আর এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি এ সংকট থেকে উত্তরণে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকটি অভিযানে হানিফ, শ্যামলী ও সেন্ট মার্টিন পরিবহনের মতো শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির কক্সবাজার থেকে আসা বাস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা। গ্রেফতার করা হয়েছে চালক-হেলপার কিংবা সুপারভাইজারকে। এসব ঘটনা যেন বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস মালিকদের। তারা বলছেন, তাদের পরিবহনের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে, ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।

বাসগুলোতে যাত্রীবেশে কিংবা চালক-সহাকারীদের সহায়তায় বিভিন্ন জায়গায় অভিনব কৌশলে লুকিয়ে আনা হচ্ছে এসব মাদক। একেকটি চালান বাসে করে রাজধানীতে পৌঁছে দিতে পারলেই মিলছে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জব্দ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবহনের বাস। এছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ এসব তথ্য জানতে পারছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

ঢাকা থেকে কক্সবাজার কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যাত্রীবাহী পরিবহন এর চলাচলে ৬৩টি কোম্পানি রয়েছে। যেখানে প্রতিদিন চলাচল করে বিপুল সংখ্যক যাত্রীবাহী বাস। এসব বাসে যাত্রীবেশে যেমন মাদক রাজধানীতে আসছে, আবার চালক, সহকারী ও সুপারভাইজারদের প্রলোভন দেখিয়েও বিভিন্ন অভিনব কৌশল নিয়ে বহন করা হচ্ছে মাদক। পরিবহন সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, এ ধরনের মাদক পরিবহন বন্ধে পরিবহন মালিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং শ্রমিক নেতাদের এক হয়ে কাজ করতে হবে। তা না হলে পরিবহন সেক্টরে আরও ভয়াবহ অবস্থায় পড়তে হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এসব ঘটনায় বেশিরভাগ সময়ে মালিকরা জানেনও না। সাধারণত স্বল্প সময়ে অধিক টাকা আয়ের প্রলোভনে পড়েই অনেক পরিবহন শ্রমিক এ ধরনের কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ধরা পড়ার পরে তাদের ঠাঁই হচ্ছে কারাগারে। তবে কারাভোগের পরও অনেকেই আবার বিভিন্ন পরিবহনে গাড়ি চালাচ্ছেন। মালিকদের তারা এমনভাবে বোঝাতে সক্ষম হন- যেহেতু তারা আগে একটি অপরাধ করে ফেলেছেন, সেই অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত করতেই আবার ওই রুটেই গাড়ি চালাতে চান। বিশেষ করে কক্সবাজার রুটের গাড়িতে দায়িত্ব পালনে ওইসব শ্রমিকদের বেশি প্রবণতা দেখা যায়।

‘মালিকদের অগোচরেই’ এ ধরনের অপকর্ম করে আসছে পরিবহনের ড্রাইভার ও হেলপার। এতে করে পরিবহনগুলোতে বাড়ছে অস্থিরতা বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে নিজেদের মধ্যে আতঙ্ক। অপরাধ সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও অপরাধের বোঝা মাথায় পেতে নিতে হচ্ছে পরিবহন মালিকদের। যদিও পরিবহন মালিকরা বলছেন, শ্রমিকদের এসব থেকে দূরে রাখতে নানান উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা।

শ্যামলী এন আর পরিবহনের স্বত্বাধিকারী রাকেশ চন্দ্র দাস বলেন, কক্সবাজারের শ্যামলী এন আর পরিবহনের পক্ষ থেকে চালক, সহকারী এবং সুপারভাইজারদের থাকার জন্য আলাদা করে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেসব জায়গায় অবস্থান না করে কেউ যদি বাইরে অবস্থান করে, সে বিষয়টি নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।

তবে বিভিন্ন সময়ে চালক-হেলপার কিংবা সুপারভাইজারদের এ ধরনের অপকর্মের কারণে আমাদের পরিবহনের অনেক সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে পরিবহনের গাড়িটি আদালতের আদেশ না হওয়া পর্যন্ত থানায় পড়ে থাকছে। কোনও কোনও গাড়ি তিন থেকে চার মাস সময় লাগছে আদালতের আদেশের পর গাড়িটি নিয়ে আসার জন্য। এতে করে আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে সেই সাথে আমাদের ব্র্যান্ডের যে সুনাম রয়েছে তাও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে আমরাও দুশ্চিন্তায় রয়েছি। তবে এ থেকে পরিত্রাণের জন্য মালিক-শ্রমিক এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে মনে করি।

যাত্রীবাহী বাসে মাদক পরিবহনের সঙ্গে বাস শ্রমিকদের সংশ্লিষ্টতায় মালিকদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েত উল্লাহ খান বলেন, স্বল্প সময়ে বেশি উপার্জনের লোভে অনেক শ্রমিক মাদক পরিবহনের জড়িয়ে পড়ছে। আমরা যতটুকু সম্ভব তাদের এসব বিষয়গুলো নজরদারি রাখছি। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আমরা নিজেরাও বিব্রতকর এবং দুশ্চিন্তায় রয়েছি।

পরিবহনে যেন ঠিকমতো যাত্রীসেবা দেওয়া হয়, কোনোধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত না হয়; সে বিষয়ে মালিকদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান এনায়েত উল্লাহ খান। তিনি বলেন, মালিকদের পক্ষ থেকে নজরদারি রাখা হচ্ছে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

অভিযুক্ত শ্রমিকদের আবারও দায়িত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চালক স্বল্পতার কারণে অনেক সময় পরিবহন মালিকরা সেসব চালকদের আবারও গাড়ি তুলে দিচ্ছেন। তবে এসব বিষয়ও আমরা নজরে রাখছি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মেহেদি হাসান বলেন, অধিদফতরের হাতে এ ধরনের বেশ কয়েকটি চালান ধরা পড়েছে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আরও কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শুধু কক্সবাজার নয়, যাত্রীবাহী পরিবহনের দেশের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজধানীতে আসা বাস থেকে আমরা মাদক উদ্ধার করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারছি তাদের স্বল্প সময়ে বড়লোক বানানোর কথা বলে প্রলোভনে ফেলে তাদের মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে।

কারাভোগ করে বের হওয়া শ্রমিকরা আবারও গাড়িতে দায়িত্ব পালন করলে তাদের বিষয়ে আলাদা করে নজরদারি রাখা হচ্ছে বলেও জানান এই র‌্যাব কর্মকর্তা।