কক্সবাজারে আসতে পারে বিশাল মাপের ভূমিকম্প

বিশেষ প্রতিবেদক :

কক্সবাজারে শুক্রবার ভোরে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলেও মাটির ৬০ মিটার গভীরে থাকায় এই ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে ছোট এবং মাঝারি এসব ভূমিকম্প বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের আভাস দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কক্সবাজার জেলায় ব্যাপক ক্ষতি হবে।

বিশেষজ্ঞদের আশংকা, ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোনের কাছেই কক্সবাজারের অবস্থান।সে কারণে যে কোন মূহুর্তেই এ অঞ্চলে প্রবলমাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। ভৌগলিক অবস্থান ও অতীত ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে এমন আশংকা ব্যক্ত করছেন তারা। বাংলাদেশের পাহাড়বেষ্টিত এলাকাকে ঘিরে গত কয়েক বছর ধরে সংঘটিত মাঝারি ও তীব্রতর কয়েকটি ভূমিকম্প কক্সবাজারে ভূমিকম্পের আশংকাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শুক্রবার ভোরে কক্সবাজারের কিছু অংশে ভূমিকম্প হওয়ায় এ আতঙ্ক আরো বেড়েছে।

গবেষকদের মতে,কক্সবাজার শহর ও হোটেল-মোটেল জোন সহ জেলার অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবনই অপরিকল্পিত এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে ৭ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ২০ বা ৩০ সেকেন্ড স্থায়ী হলেই অধিকাংশ ভবনই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। একারণে জেলার মানচিত্রও পাল্টে যেতে পারে। চরম ক্ষতিগ্রস্থ হবে কক্সবাজারের পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র হোটেল-মোটেল জোন,বিমানবন্দর,নির্মিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর এতেই ক্ষতি হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। মারাত্বক পরিবেশ বিপর্যয়ও নেমে আসবে।

জানা যায়,১৯৮০-র দশক পর্যন্ত কক্সবাজারে পাঁচতলা থেকে উঁচু ভবন নির্মান করা হতো না বললেই চলে। তৎকালীন সময়ে কক্সবাজারের বেশিরভাগ বাসাবাড়িই ছিলো একতলা বা টিনশেডের। তবে নব্বইয়ের দশকের পরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিশ্বের সেভেন ওয়ান্ডর্সের তালিকায় আসলে এ শহর এক অসুস্থ প্রতিযোগীতায় মেতে উঠে। অবৈধ অলস অর্থ, সৌদি রিয়াল-ডলারের উড়াউড়ি, রিয়েল এস্টেট কোম্পানীগুলো অসম প্রতিযোগীতার এই শহরে একে একে গড়ে উঠতে লাগলো আকাশ ছোঁয়া ভবন। একতলা বাড়ি ভেঙ্গে বিশাল ভবণ,সৈকতের বালুচর দখল করে সুউচ্চ ভবণ,পাহাড়-টিলা কেটে হাউজিং প্রকল্প। এই অসুস্থ, বিকৃত, আত্মঘাতি প্রতিযোগীতার ফলে অপরিকল্পিতভাবে, কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, কোনরুপ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা চিন্তা না করে গড়ে উঠেছে একের পর এক হাই রাইজিং বিল্ডিং। এর ফলশ্রুতিতে পর্যটনের নামে অপরিকল্পিত নগরায়ন,সংশ্লিষ্ঠ কর্তাদের উদাসীনতায় দেখা দিয়েছে এ ভযংকর পরিস্থিতির। তিলে তিলে তিলোত্তমা হয়ে উঠার কথা ছিলো যে ছিমছাম, ঘরোয়া শহরটির তা এখন পরিনত হয়েছে মৃত্যুকূপে।ভূমিকম্পের মৃত্যুকূপ। প্রতিদিনই পর্যটন শহরের বিভিন্ন এলাকায় চোখে পড়ে বিল্ডি কোর্ড (ইমারত আইন) না মেনে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য ভবন ও স্থাপনা। প্রভাবশালী মহল প্রভাব খাটিয়ে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে আবার অনেক ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে ভবন নির্মাণ করেছে। শহরের ঘোনার পাড়া,বৈদ্যের ঘোনা,সিকদার পাড়া, বার্মিজ মার্কেট, বাহাড়ছড়া, আলীর জাহাল, টেকপাড়া, কালুরদোকান, কলাতলী, হোটেল মোটেল জোন, লাইট হাউস পাড়া সহ একাধিক এলাকায় বিল্ডিং কোড কিংবা ইমারত আইন না মেনে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। যার অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে,কক্সবাজার ও চট্রগ্রাম জেলায় আঘাত হানার অপেক্ষায় ৮ রিখটার স্কেল মাত্রার ভূমিকম্প। শুক্রবারের মৃদু, হালকা, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো তীব্র ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করছে। তাদের মতে, একটি তীব্র ভূমিকম্পই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে কক্সবাজার জেলার পৌর শহর ও উপশহরকে। বিল্ডিং কোড ও কোনো নিয়মনীতি না মেনে অপরিকল্পিতভাবে কক্সবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত বহুতল ভবন। ফলে চরম ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পর্যটন নগরী। বিশেষ করে হোটেল-মোটেল জোন,কলাতলী এলাকায় যেভাবে একের পর এক তাড়াহুড়ো করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তাতেই আতঙ্ক বেড়েছে বেশি । এছাড়া সেন্টমার্টিণ দ্বীপে যেভাবে অসংখ্য ভবণ নির্মাণ হয়েছে ৮ বা ৮.৫ মাত্রার ভুমিকম্পের প্রভাবে সুনামী হলে সাগরের পানিতে তলিয়ে যেতে পারে দ্বীপটি।

ইইআরসির গবেষণায় বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে দক্ষিণে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও উত্তরে ভারতের আসাম-মেঘালয় হয়ে হিমালয় অঞ্চল পর্যন্ত একটি ফল্ট লাইন রয়েছে। ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়ায় ওই ফল্ট লাইন অধিক সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশ দিয়ে ওই ফল্ট লাইনটি যাওয়ার কারণে তীব্র ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে এ অঞ্চলে। এতে ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম নগরী ও কক্সবাজার শহরের লাখ লাখ মানুষ। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান, ইউরেশীয় অঞ্চলে একাধিক ফল্ট লাইনের বিস্তার ও অব্যাহত সঞ্চালনের কারণে বাংলাদেশ এবং আশপাশ অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয় হিসেবে চিহ্নিত।১৯৭৯ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ সিসমিক জোনিং ম্যাপে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামকে বিপজ্জনক অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কক্সবাজার জেলার কৃতি সন্তান ড. অলক পাল বলেন, ‘ঘন ঘন ভূমিকম্প তীব্র ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করে। তাই ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে দুর্যোগ এড়াতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। কক্সবাজারে অপরিকল্পিত নগরায়ন আর যত্রতত্র ভবন নির্মাণের কারণে ভুমিকম্প ও ভবন ধ্বসের ঘটনায় এখানকার জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হতে পারে বলেও জানান তিনি। কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন কোনো সর্তকতামুলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি এখানকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) পরিচালিত ‘আর্থকোয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারিং রিচার্স সেন্টারের (ইইআরসি) গবেষণা তত্ত্বাবধানকারী অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশের ভূমিকম্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিন বছর গবেষণা করে ইইআরসি। গবেষণায় দেখা যায়, এ অঞ্চলে আঘাত হানার অপেক্ষায় রয়েছে ৮ রিখটার স্কেলের ছয়টি ভূমিকম্প। হিমালয় বেল্টে অবস্থান হওয়ায় চট্টগ্রাম অঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এসব ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ।তিনি আরও বলেন,বাংলাদেশ-মিয়ানমার চ্যুতি থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের অবস্থান কাছে। এখানে ২ লাখের অধিক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমরা বলছি। কিন্তু কোন ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ তা চিহ্নিত করতে কোনো প্রকল্প হাতে নেয়া হয়নি। এগুলো কীভাবে ঠিক করা হবে, তা নিয়েও কেউ কথা বলছে না। সরকারি ভবন সরকার ঠিক করবে, বেসরকারি ভবন বেসরকারি উদ্যোগে হবে। তবে যেভাবে হোক না কেন, দুর্যোগ কাটাতে এই পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন,বন্দর, বিমানবন্দর,বিদ্যুৎকেন্দ্র,হোটেল-মোটেল,বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিজ সহ হাজার হাজার স্থাপনা চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

এ ব্যাপারে ইঞ্জিনিয়ার ইনিস্টিটিউশন বাংলাদেশ,কক্সবাজার উপকেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ঠ পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার বদিউল আলম বলেন-কক্সবাজারের সরকারী ভবণগুলোর ৫০% ভুমিকম্প প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বেসরকারীভাবে নির্মিত অধিকাংশ ভবণ ৭ মাত্রার ভুমিকম্প প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকলেও ৫/৬ তলার উপরে হওয়ায় সেগুলো মারাত্বক ঝুঁকিতে রয়েছে। ৭ মাত্রার ভুমিকম্প যদি ৩০ বা ৪০ সেকেন্ড স্থায়ী হয় তবে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বিল্ডিং মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।এরফলে ব্যাপক প্রাণহাণিও হতে পারে। তিনি আরও বলেন,বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আগামীতে ৮.৫ মাত্রার ভুমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। আর এর প্রভাব পড়তে পারে কক্সবাজারেও। এতে করে ভবন ধ্বসের পাশাপাশি ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে।তিনি আরও জানান, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি হ্রাসে কক্সবাজারের মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরী। এই প্ল্যানের মধ্যে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে- ৫/৬ তলার উপর ভবণ না করা,নগরায়ণ, জমি ব্যবহার, শহরকে মাইক্রোজোনে বিভক্তকরণ ইত্যাদি।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সহ সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার কান পাল জানান, কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শহর ও পর্যটন এলাকার সব ভবনকে ভূমিকম্প প্রতিরোধক করা। এজন্য নতুন ভবন নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা করতে হবে। মাটির ধরণের উপর নির্ভর করে ভবনকে একতলা বা বহুতল করতে হবে। জলাশয় বা নাল জমি ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা যাবে না। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ডিজাইনে এবং মানসম্পন্ন নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে দালান তৈরি করতে হবে। আর পুরনো দুর্বল ভবনগুলোকে সংস্কার করে শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। সম্ভব না হলে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে কোন অবস্থাতেই ভবন নির্মাণ করা যাবে না। তিনি আরও জানান,ভূমিকম্প হলে উদ্ধার কাজের জন্য সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে ফায়ার ব্রিগেড ও ডিফেন্স সার্ভিসকে। তবে কক্সবাজারে ৮ উপজেলার মধ্যে ৪টিতে ফায়ার ষ্টেশন রয়েছে। দ্বীপাঞ্চলগুলোতে স্টেশন নেই। আবার যে ৪ উপজেলায় আছে, সেগুলোতেও তেমন কোনো উদ্ধার কাজের যন্ত্রপাতি নাই। পুনর্বাসনের অবস্থা কেমন তা আর না বলাই শ্রেয়। তাছাড়া পৌর শহরের বিভিন্ন অলি-গলির সরু রাস্তা দিয়ে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকা প্রায় অসম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে প্রধান দায়িত্বটা পৌরসভার উপরই বর্তায়।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে: কর্নেল (অব:) ফোরকান আহমদ বলেন-ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহিৃত করা হচ্ছে। অন্যদিকে নিয়মনীতি না মেনে কক্সবাজারে অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এসব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে।