কক্সবাজারে ঝুলে আছে ৯৬ জনের সম্পদের অনুসন্ধান

অনলাইন ডেস্ক •

কক্সবাজার জেলায় সরকার সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ৭৩টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প, কক্সবাজার শহরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও সিআইডির কার্যালয় নির্মাণ এবং মহেশখালীতে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) নির্মাণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে জালজালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় দুদক। আর এসবের তদন্ত করছিলেন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সদ্য চাকরি হারানো কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন।

আর তার অপসারনে কক্সবাজারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ ওঠা ৯৬ জনের সম্পদ অনুসন্ধান ঝুলে আছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন প্রভাবশালীদের দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে তাঁদের অবৈধ সম্পদের তথ্য পান মো. শরীফ উদ্দিন।

কক্সবাজারের দুর্নীতির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লেনদেন, জমির ভুয়া মালিকানা সেজে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা আত্মসাতে তাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

শরীফ উদ্দিন বলেন, কক্সবাজারের দুর্নীতির ঘটনায় দুই ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে আদালতে আবেদন করার জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও অনুমোদন পাওয়া যায় দেরিতে। এর মধ্যে ওই ব্যক্তিরা টাকা তুলে নেন।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনটি প্রকল্পেই জমির ক্ষতিপূরণের টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি দালাল চক্র সক্রিয় ছিল। তারা ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ কমিশন হিসেবে নিত, যা দালাল চক্রের হাত দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। কিন্তু শরীফের দেওয়া প্রতিবেদন দুদক গ্রহণ না করে তা পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

শরীফ উদ্দিন প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে ৯৬ জনের সম্পৃক্ততা পান। এর মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতা, পৌরসভার কাউন্সিলর, মহেশখালীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় ১৭ জন রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখাসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে টাকা লেনদেনে জড়িত ৫৮ জনের সম্পৃক্ততা পায় দুদক। তাঁরা দালাল হিসেবে কাজ করতেন। এসব দালালের বাইরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, মহেশখালীর ইউনিয়ন পরিষদ ও কক্সবাজার পৌরসভার সচিবসহ সরকারি চাকরিজীবী ছয়জন, স্থানীয় পাঁচজন সাংবাদিক, আইনজীবী আটজন ও দুজন ব্যাংকারের নাম অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।

কক্সবাজারের তিন প্রকল্পে শরীফের করা অভিযোগপত্রের সুপারিশ বাতিল করে সেটা পুনঃ তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে বলে জানান দুদকের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে সবে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কাগজ, নথিপত্র সব বুঝে নিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে দুদক দুর্নীতিবাজ কাউকে ছাড় দেবে না।

২০১৮ সাল থেকে এসব প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এলএ শাখার সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খান আটকের পর ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ পেতে থাকে। এরপর দুদক তদন্তে নামে। এই ঘটনায় করা মামলায় তখন ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।তবে কক্সবাজারের ঘটনায় যে ৯৬ জনের সম্পদের অনুসন্ধান করার সুপারিশ করেছিলেন শরীফ, সেই বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দুদক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামে দুদকের পরিচালক মাহমুদ হাসান বলেন, অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে করা হবে।

এদিকে কক্সবাজারে একটি প্রকল্পে জালজালিয়াতির মাধ্যমে বেলায়েত হোসেন নামের এক ব্যক্তি ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে তথ্য পান শরীফ উদ্দিন। তাঁর ব্যাংক হিসাবে থাকা ৫০ লাখ টাকাসহ যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের অনুমোদনের জন্য ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু সেটির অনুমোদন হয় ছয় মাস পর ৩০ জুন। তবে ক্রোকের জন্য দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে কোনো আবেদন করা হয়নি। একইভাবে কক্সবাজার পৌরসভার মো. মিজানুর রহমানের ব্যাংক হিসাবে থাকা ৪ কোটি টাকা (এফডিআর) যাতে তুলতে না পারেন, সে জন্য হিসাব স্থগিতের অনুমোদনের চিঠিও আসে দেরিতে। এর আগেই টাকা তুলে নেন মিজানুর রহমান।

দুর্নীতিবাজদের স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের অনুসন্ধান না হলে তাঁরা আরও উৎসাহী হবে বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজারের সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান। তিনি বলেন, সম্পদের অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র। তাঁদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত।

এ ব্যাপারে শরীফ উদ্দিন বলেন, কক্সবাজারের ল্যান্ড অ্যাকুইজিশনের (ভূমি অধিগ্রহণ) তদন্ত করেছি এবং ওই তদন্ত করতে গিয়ে যারা প্রকৃত ভূমি মালিক তাদের যে হয়রানি ও পদে পদে টাউট থেকে শুরু করে অন্যদের কমিশন দিতে হতো, আমি সেটা উদঘাটন করার চেষ্টা করেছি, অনেকখানি করেছি। ওই টাউটদের আমি প্রায় ৪০-৫০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করার, রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা করার, বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি।

রোহিঙ্গাদের এনআইডি-পাসপোর্ট। বাংলাদেশে প্রায় ২-৫ লাখ রোহিঙ্গা এনআইডি, পাসপোর্ট বা অন্যান্য কাগজপত্র পেয়েছে। এটা আমি প্রথম ধরেছি। তাদের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা হয়েছে আমাদের কমিশন থেকে। বেশিরভাগ মামলার বাদী আমি। এই ২০টি মামলা সম্পূর্ণভাবে আমার অনুসন্ধানকৃত।

তিনি আরও বলেন,দুদকের সুনাম ও রাষ্ট্রের সুনাম বৃদ্ধির জন্য দুর্নীতিবাজদের অবৈধ-অপরাধলব্ধ সম্পদ জব্দ করার জন্য আমি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এতে যদি দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে, তাহলে আমার কোনো জবাব নেই।