কক্সবাজারে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তাবলয়

শাহীন মাহমুদ রাসেল :

শীতের এই সময়টাতেই বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকদের আগমন সবচেয়ে বেশি হয়। এই সময়টাতে দেশি পর্যটকেরও ভিড় হয়। প্রকৃতি ঢাকা পড়ছে কুয়াশার চাদরে। চারিদিকে বইছে শীতল হাওয়া। শীতের এ দারুণ সময়টাকে উপভোগ করতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ধুম পড়েছে। এ সময়টাতে বিশ্বের দীর্ঘতম এ সৈকতে বিদেশি পর্যটক ছাড়াও দেশি পর্যটকদেরও ব্যাপক সমাগম লক্ষ্য করা যায়।

কক্সবাজার দেশের প্রধানতম পর্যটন কেন্দ্র। সেখানকার বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকতকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে। কিন্তু সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা প্রায় বার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এসে কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ সুযোগে জঙ্গিগোষ্ঠী পর্যটন এলাকায় নাশকতা চালাতে পারে। এর জন্য তারা রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে পারে।

এমন তথ্য সরকারের কাছে থাকায় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপত্তাবলয় ও কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সম্ভাবনার খাত পর্যটনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে এ দেশে আসা রোহিঙ্গারা যাতে নির্দিষ্ট ক্যাম্পের বাইরে তথা পর্যটক এলাকায় আসতে না পারে, সে জন্য সব চেকপোস্টে দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের মধ্যে ভীতি ছড়াতে কেউ যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে উস্কানি দিয়ে কিছু লেখে, তাদেরও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর এরই মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সংশ্নিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনটাই জানিয়েছেন একাধিক প্রশাসন সূত্র।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দপ্তরকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, আগে এবং সম্প্রতি এ দেশে আসা রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করে একটি মহল কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এই অপতৎপরতার সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

বিদেশি পর্যটকরা সমুদ্রসৈকতের যেসব এলাকায় অবস্থান করবেন, সেখানে বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। একই সঙ্গে ছদ্মবেশে গোয়েন্দা নজরদারি ও নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে। পর্যটন শহর কক্সবাজারে পাড়া-মহল্লায় স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও সাধারণ ব্যক্তিদের সমল্প্বয়ে কমিটি গঠন করা হবে। সন্ত্রাসীদের কেউ আশ্রয়, অর্থায়ন ও মদদ দিচ্ছে কি-না, সে ব্যাপারে নিবিড়ভাবে খোঁজ নেবে এই কমিটি। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হবে।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে পর্যটন বিশেষজ্ঞ মাসুদ হোসেন বলেন, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ উপত্যকা রয়েছে। এটি বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ একটি উপত্যকা। সেখানে নব্বইয়ের দশকে প্রথম রোহিঙ্গাদের এসেছে। তখন যে ক্ষতি হয়েছিল, তা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এবার যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এসেছে, তা দীর্ঘমেয়াদি হলে ওই অঞ্চলের ভারসাম্য আরও নষ্ট হবে। তাই নীতিনির্ধারকদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির জায়গা থেকে পর্যটন ও উম্নয়নকে দেখতে হবে।

এ ব্যাপারে স্থানীয়রা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা জেনেও মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আরাকানে আসলে তাদের জীবিকার সুযোগ নেই। অন্যদিকে, কক্সবাজারে তুলনামূলক বেশি আয় হওয়ায় সেখানে বিভিম্ন শ্রমনির্ভর কাজে রোহিঙ্গারা যুক্ত আছে। কিন্তু বর্তমানে এর মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এটি পর্যটকদের চলাফেরা ও বিভিম্ন স্পট দেখার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। এই মাস থেকে পর্যটন মৌসুম শেষ হচ্ছে। এ সমস্যা পর্যটনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সরকার রোহিঙ্গাদের একটি সুনির্দিষ্ট জোনের মধ্যে নিয়ে আসার কাজ করছে। এটি সম্পম্ন হলে সমস্যা অনেকাংশে উত্তরণ হবে।

জ্যাক নামের একজন বিদেশী নাগরীক বলেন, পর্যটকদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা আসায় পর্যটন শহর কক্সবাজারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে শরণার্থী শিবিরের বাইরে আসতে না পারে, সে জন্য বিভিম্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের যাতে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য সমুদ্রসৈকতে গোয়েন্দা নজরদারি ও পুলিশি টহল অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, পর্যটনের অন্যতম খাত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সংশ্নিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার, তাই সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান বলেন, পর্যটন শহর কক্সবাজারে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। কেউ যাতে বিশৃগ্ধখলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য কক্সবাজারের টু্যরিস্ট পুলিশক সব সময় তৎপর রয়েছে। সেই সঙ্গে চলছে গোয়েন্দা নজরদারিও।