কক্সবাজারে পিবিআইয়ের জমি অধিগ্রহণ জালিয়াতি যেভাবে প্রকাশ্যে আনেন শরীফ

মুহিববুল্লাহ মুহিব, কক্সবাজার •

পর্যটননগরী কক্সবাজারে প্রশাসনিক কার্যালয় করার জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রকল্প হাতে নেয় আলোচিত মামলাগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন করা পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ‘পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই। কয়েক বছর আগে শুরু হওয়া ওই প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনায় ৬১ জনকে অভিযুক্ত করে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে।

দুদক চেয়ারম্যান বরাবর এই অভিযোগপত্র জমা দেন দুদকের সদ্য চাকরিচ্যুত উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন চৌধুরী। অভিযোপত্র জমা দেয়ার পর পরই তিনি চাকরিচ্যুত হওয়ায় প্রকল্পটি আবার আলোচনায় এসেছে।

‘অব্যাহতভাবে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করায়’ কমিশনের ‘ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে’শরীফ উদ্দিনকে নোটিশ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে দুদক।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, পিবিআইয়ের জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পটিতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ২০২০ সালে দুদকেই অভ্যন্তরীণ একটি মামলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন শরীফ উদ্দিন।

অভিযোগপত্রে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর কক্সবাজারের ঝিলংঝা মৌজায় পিবিআই ও সিআইডির অফিস করতে এক একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। পরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এক একর জমি অধিগ্রহণ করে। এরই মধ্যে অধিগ্রহণ করা ৯৮ শতক জমির বিপরীতে ২০টি পৃথক চেকের মাধ্যমে ২৬ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার ১০৫ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা।

তড়িঘড়ি করে তুলে নেয়া এসব চেক নেয়া ব্যক্তিদের নিয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে দুদক। এর পরই উঠে আসে পিবিআই প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ জায়গার মধ্যে অনেকের কম জমি থাকলেও বেশি জমি দেখিয়ে যেমন ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করেছেন, তেমনি অধিগ্রহণ প্রকল্পের বাইরের জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পের মধ্যে দেখিয়েও প্রশাসনের সহযোগিতায় ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এভাবে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সরকারি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানতে পারেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা শরীফ।

এসব জালিয়াতি ও দুর্নীতিতে একজন সাবেক জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মিলে চারজন, পুলিশ সুপার পর্যায়ের দুজন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একজন, সাবেক ইউএনও, দুজন সাংবাদিক, স্ত্রীসহ একজন সিআইপি, স্ত্রীসহ একজন আইনজীবী, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, সাব-রেজিস্ট্রার, কানুনগো, ১০ জন সার্ভেয়ারসহ বেশ কয়েকজন দালাল ও সুবিধাভোগীসহ ৬১ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পান দুদক কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে ওই প্রকল্পে প্রায় সোয়া ২২ কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগপত্রে জানায় দুদক।

এদিকে ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের অভিযানে ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়ার ওয়াশিম খান। ওই ঘটনায় দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন সার্ভেয়ার মো. ওয়াসিম খানকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করেন।

মামলাটির তদন্তে নেমে সরকারি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ কাজে দুর্নীতিতে জড়িত প্রায় ১৩ জনকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করেন তদন্ত কর্মকর্তা শরীফ। এর মধ্যে চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে এসবের মধ্যে আলোচিত পিবিআই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ দুর্নীতি।

পিবিআইয়ের ভূমি অধিগ্রহণের দুর্নীতি নিয়ে ২৯১ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দুদকে উপস্থাপনের পর পরই প্রভাবশালীদের হুমকি ও রোষানলে পড়েন তদন্ত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। প্রথমে পটুয়াখালীতে বদলি ও সবশেষ চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় পিবিআইয়ের জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পের মতো বড় একাধিক প্রকল্পের দুর্নীতি সামনে আনা এ কর্মকর্তাকে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের বলেন, ‘দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতি নিয়ম অনুযায়ী হয়নি। যদি তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থেকে থাকে, তাহলে প্রকাশ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল।’

সম্প্রতি দুদক থেকে চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘কক্সবাজারের অতি গুরুত্বপুর্ণ ও চাঞ্চল্যকর কিছু মামলার তদন্ত-অনুসন্ধান করেছি। শুধু কক্সবাজার নয়, চট্টগ্রামের একাধিক দুর্নীতিবাজের মুখোশ আমি উন্মোচন করে দিয়েছি। যেটি আমার চাকরিচ্যুত হওয়ার বড় কারণ। রাঘববোয়ালরা বিভিন্ন সময় হুমকি ও চাকরি কেড়ে নেয়ার হুমকি দিয়েছিল।’

/নিউজবাংলা/এম এম