কক্সবাজারে বাড়ছে কিশোর গ্যাং’র দৌরাত্ম্য

মাহাবুবুর রহমান •

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং অপরাধী চক্র। এদের অপরাধ প্রবণতা দেখে হতবাক হয়ে পড়ছে প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকজন। সচেতন মহলের দাবী, অবৈধ পথে বিপুল টাকা আয়ের সুযোগ এবং পিতা মাতার অসচেতনার অভাবে কিশোর বয়সে অপরাধের পথে পা বাড়াচ্ছে অধিকাংশ কিশোর। সমাজের একটি বড় অংশ এখন এই পথে চলছে -এটা ধারাবাহিক থাকলে ভবিষ্যতে সমুহ বিপদ অপেক্ষা করছে, তাই এখন থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এদিকে প্রশাসন বলছে, কক্সবাজারে মাদকের টাকা এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে। তাই কেউ কাউকে মানতে চায় না। ফলে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। তবে এটা নিয়ন্ত্রনে পাড়া মহল্লায় ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

সর্রশেষ গত রোববার রাতে শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয় আনোয়ার হোসেন (৩২) নামের এক যুবক। তিনি বগুড়ার আদমদীঘি এলাকার তবিবুর রহমানের ছেলে। চাকরি সূত্রে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার শহরের বিজিবি ক্যাম্প চৌধুরীপাড়ার বসবাস করতেন। কক্সবাজারে মেডিপ্লাস নামে একটি টুথপেস্ট কোম্পানিতে বিক্রয়কর্মী (এসআর) হিসেবে চাকরি করতেন।
স্থানীয়দের দাবী প্রায় ৪/৫ বছর আগে থেকে শহরের বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় ছিনতাইকারীর একটি চক্র থাকতো। প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে কারন কয়েক বছর ধরে পালিয়ে গেলে সম্প্রতি আবারো তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এলাকাবাসী জানান, এই গ্রুপে সব কিশোর বয়সের ছেলে আছে। তাদের মধ্যে কিছু আছে বখাটে আবার কিছু আছে মাদকাসক্ত, কয়েকজন পেশাদার ছিনতাইকারী।

শহরের আলীর জাহাল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মুবিনুল হক বলেন,সিটি কলেজ, সাহিতিক্যা পল্লী এলাকায় বেশ কয়েকজন কিশোর অপরাধীর অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। কয়েকজন আছে কয়েক মাসের মধ্যে তারা অন্তত ৩/৪টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে। থানায় অভিযোগ ও হয়েছে তাদের আটক করা হলেও আবার ছাড়া পায় এতে আবার তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে। আমরা থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে।

পাহাড়তলী সমাজ কমিটির নেতা সমাজ সেবক মোহাম্মদ রফিক বলেন, কিশোর বয়সী যে ছেলেটি দামী মটরসাইকেল হাকিয়ে চলে তার বাবা ছোট তরকারীর দোকান করে অথবা এখনো রাজমিস্ত্রি কাজ করে। তাহলে ছেলে এত টাকা কোথায় পায়। মুলত ইয়াবার আগ্রাসন এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে। তাই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। আর কিশোর বয়সের অপরাধীদের কেউ দমাতে পারেনা। কারন অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকে। কাউকে সামাজিক ভাবে কিছু বলা হলে সে উল্টো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সমাজপতিদের চাপ দেয়। তাই কেউ কিছু বলেনা। এভাবেই সমাজে অধপতন তৈরি হচ্ছে।

শহরের ক্রাইমজোন খ্যাত সৈকত পাড়া, লাইট হাউজ, বাস টার্মিনাল এলাকার বেশ কয়েকজন মুরব্বীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখানে প্রতিটি এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রন করে কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা। তারাই ঠিক করে চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে অপহরণ, পতিতা ব্যবসা সব কিছ।ু আবার তাদের নিয়ন্ত্রন করে কতিপয় নেতা।

স্থানীয়দের দাবী, ইয়াবা শেষ করছে কক্সবাজারের সব কিছু। আমরা এমনও দেখেছি পাশের বাড়ির ১২/১৫ বছরের ছেলেটি যখন ইয়াবা ব্যবসা করে বিপুল টাকা আয় করে দামী গাড়ী ব্যবহার করছে। পরিবারকে ভাল টাকা পয়সা দিচ্ছে। তখন অনেক অভিভাবক তার ছেলেকে উৎসাহিত করে ইয়াবা ব্যবসা করার জন্য। ফলে সেই ছেলেটি কখনো ভাল পথে আসতে পারেনা। এমনকি অনেক মেয়েও এখন অপরাধী হয়ে উঠছে।
এ ব্যপারে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাম মোহন সেন বলেন, আমি এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে একটা জিনিস দেখেছি যত ছাত্র এস.এস.সি পাস করে বের হয় তার অর্ধেকও অনার্স বা ডিগ্রি পর্যন্ত পৌছাতে পারেনা। আর আমাদের স্কুলটা জেলার সব চেয়ে ভাল। এই স্কুলের ছেলেদের এই অবস্থা হলে গ্রামের স্কুলের ছেলেদের কি অবস্থা সেটা চিন্তা করলে অবাক হতে হবে।

তিনি বলেন, আমি এমন অভিভাবক দেখেছি তাদের জিজ্ঞেস করলে ছেলে কি করে তারা খুব গর্ব নিয়ে বলে ছেলে ভাল টাকা আয় করে। কি এমন ব্যবসা সেটা জানতে চাইলে বলেন, সেটা সেই ভাল জানে। আমি জানিনা। আমি মনে করি অভিভাবকদের কারনে অল্প বয়সে অনেক ছেলে অপরাধের দিকে পা বাড়ায়।

এদিকে শহরের টেকপাড়া, বাহারছড়া, নুনিয়ারছড়া, ফিশারী ঘাট, সমিতি পাড়া, পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া সহ সব জায়গায় ব্যাপক হারে কিশোর অপরাধী বাড়ছে বলে জানান স্থানীয়রা।

মহেশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শরীফ বাদশা বলেন, মহেশখালীতে বেশির ভাগ বড় বড় অপরাধে ১২ বছর থেকে ২০ বছরের ছেলেরা জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া যায়। আমি মনে করি এটা সমাজের অবক্ষয়। আর সরকার থেকে একটা আইন করে দেওয়া দরকার। কত বছর বয়সের ছেলেরা রাজনৈতিক মিছিল মিটিংয়ে অংশ গ্রহন করতে পারবে। একই সাথে কত বছর বয়স হলে সামাজিক বা রাজনৈতিক কাজ কর্ম করতে পারবে। এছাড়া যারা স্কুল থেকে ঝরে পড়া তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচী নেওয়া দরকার।

চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীদের কারনে মানুষ এখন সম্মান নিয়ে রাস্তায় চলতে পারেনা। আগে যেখানে চায়ের দোকানে বাপ চাচারা বসে থাকলে ছোট ছেলেরা আসতো না। সেখানে এখন ছোট ছেলেদের সিগারেটের গন্ধে মুরব্বীরা বসে থাকতে পারেনা। মূলত মাদকের অবৈধ টাকার কারনে সমাজের এই অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। যার বাপ দাদা কোন দিন রিক্সায় চড়েনি গ্রামে এখন তার ছেলে নোহা নিয়ে চলাফেরা করে। ফলে মানুষ তার কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে।

এ ব্যপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ শাহজাহান আলী বলেন, কিশোর গ্যাং বা অল্প বয়সের অপরাধী শুধু শহর কেন্দ্রিক নয় পুরো উপজেলা বা গ্রামে গঞ্জের অবস্থা আরো ভয়াবহ। মূলত তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার, মাদকের টাকার ছড়াছড়ি, সাথে কিছু অসৎ গ্রাম পর্যায়ের নেতার কারনে কিশোর অপরাধী বাড়ছে। দ্রুত এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অবস্থা ভয়াবহ হবে। আর এই পরিস্থিতির জন্য সব চেয়ে বেশি দায়ী অভিভাবকরা। তারাই সন্তানদের সঠিক দায়িত্ব পালন না করাই তারা অপরাধী হয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।