কক্সবাজারে বিষাক্ত মদের সিন্ডিকেট: মিলছে ভয়ঙ্কর ‘মিথাইল’, বিষক্রিয়ায় বাড়ছে মৃত্যু

মুহিবুল্লাহ মুহিব •

অনেকে মনে করেন, কক্সবাজার বিনোদন স্পট, তাই এই শহর উৎসবে কিছুটা মাতাল হতেই পারে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত হচ্ছে, মদ পান করে অসুস্থ হবার ঘটনা।

এমন এক দুঃ সংবাদ গেল বুধবার অতিরিক্ত মদ পান করে ঢাকার লাবণী আক্তার নামে এক পর্যটকের মৃত্যু। একইদিন পৃথক হোটেলে আরও দুই পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনা নানা রহস্যের জাল বেঁধেছে।

এক পর্যটকের মাদক সেবনে মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর কক্সবাজারে অনিয়ন্ত্রিত মাদকের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, এ্যালকোহলের সাথে বিষাক্ত মিথাইল মিশ্রণের।

চিকিৎসকরা বলছেন, কক্সবাজারে ঘুরতে আসা পর্যটকদের অনেকেই যুবক-যুবতি। যাদের কেউ কেউ এ্যালকোহলের সাথে ইয়াবা ও গাঁজা মিশিয়ে পান করে বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কোন কোন মদে মিলেছে মিথাইলের উপস্থিতি। তারা প্রায় প্রতিদিনই মাদক সেবন করে অসুস্থ পর্যটকের চিকিৎসা করেন। গেল এক বছরে যা দাড়িয়েছে শতাধিকে।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (ক্লিনিক্যাল ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ) ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির বলেন, পর্যটকদের অনেকেই যুবক যুবতি। যাদের কেউ কেউ এ্যালকোহলের সাথে ইয়াবা পান করায় বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোন কোন মদে মিলেছে মিথাইলের উপস্থিতি। ময়না তদন্ত না হওয়ায় এসব নিশ্চিত হওয়া যায় না তেমন।

পুলিশ বলছে, প্রাথমিক তদন্তে তাঁরা প্রমাণ পেয়েছেন মৃত ও অসুস্থ ব্যক্তিরা মদ পান করেছিলেন। কিন্তু মৃত ব্যক্তিদের স্বজন ও অসুস্থরা সামাজিক কারণে ঘটনাটি নিয়ে এগোতে চান না। তাঁদের অসহযোগিতার কারণে তদন্তে সামনে এগোনো যায় না। ময়না তদন্ত করতেও রাজি হননা এসব মৃত ব্যক্তিদের স্বজনরা। যার ফলে তাদের মুত্যুর আসল কারণ থেকে যায় আজানা।
তবে এবার সেই বাঁধা কাটিয়ে বুধবার তিন পর্যটকের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে ময়না তদন্ত করা হয়েছে। এসব তদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ হয়তো মিলবে।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি তদন্ত মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, তিনজনের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েছে। তাই পুলিশ অধিকতর তদন্তের স্বার্থে এবং মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে ময়না করেছে। এখন প্রতিবেদনের অপেক্ষায়।

তিনি আরও জানান, এসমস্ত ঘটনায় পরিবারের পক্ষের লোকজন ময়না তদন্ত করাতে রাজি থাকেন না। তাই এসব ঘটনার অন্তরালেও যাওয়া হয়না। কিন্তু এ তিনজনের মৃত্যুতে মামলাও হয়েছে। ময়না তদন্তও হচ্ছে। তদন্তে গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশ।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেবে কক্সবাজরের অনুমোদিত বারের সংখ্যা ৯টি। নিয়ম না মেনে এইসব বার থেকে পার্সেল যায় বাইরের হোটেলে। এছাড়াও খালি বোতল সংগ্রহ করে সেই বোতলে বিষাক্ত মদ তৈরি হচ্ছে মেথিলেটেড স্পিরিট দিয়ে। সাধারণত দেশি-বিদেশি মদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় রেক্টিফায়েড স্পিরিট। আর এসব মদ যতটা না ‘বারে’ বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে বেশী হোটেল-মোটেল জোনে মিলছে। প্রশাসনের বিভিন্ন অভিযানে সেরকম মদ ধরাও পড়ছে।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জেষ্ঠ এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দৈনিক কক্সবাজার। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- শিল্পে ব্যবহৃত মিথাইল বা মিথানল দেখতে ও গন্ধে অনেকটা রেকটিফায়েড স্পিরিটের মতোই। এটির দাম কম হওয়ায় ভেজাল হিসেবে মিথানল মিশিয়ে কালোবাজারির মাধ্যমে তা পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেন ভেজাল মদের ব্যবসায়ীরা। ১০ মিলিলিটার বিশুদ্ধ মিথানল একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। আর পানি বা অন্য পদার্থ মিশ্রিত ২৫ থেকে ৯০ মিলি মিথানল সেবনের পর যথাসময়ে চিকিৎসা না পেলে মুত্যু ঘটতে পারে। মিথানল শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত করে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। যার কারণে মৃত্যু হয়।

তিনি আরও জানান-অনেক সময় ভেজাল হিসেবে ডিএস অর্থাৎ ডিনেচার্ড স্পিরিটও (উড বার্নিস নামে পরিচিত-কাঠের দোকানে পাওয়া যায়) ব্যবহার করে। মূলত এই দুইটাই অনেক সময় ভেজাল হিসেবে ব্যবহার করে। কক্সবাজারে ‘বারে’র চেয়ে খোলাবাজারের মদগুলোতে এসবের ব্যবহার বেশী।

বিশেষ করে হোটেল নিরাপত্তাকর্মী, সিএনজি অটোরিক্সা ও ইজিবাইক চালকরা পর্যটকদের কাছে এসব মদ সরবারহ করে থাকে।

তার কথার সুত্র ধরে রোববার দিনভর অনুসন্ধান করা হয়। তার সত্যতাও মিলেছে। এসব মাদক বহনকারী হিসেবে থাকে বেশিরভাগ হোটেলের নিরাপত্তা কর্মী, সার্ভিসম্যান, টমটম, রিক্সা সিএনজি কখনো কখনো প্রাইভেট গাড়ী। স্বীকারও করলেন কিছু মাদকবহনকারী পরিবহনের চালক ও প্রত্যক্ষদর্শী।

একটি আবাসিক হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী রিফাত (ছদ্ধনাম) কাছে দাবি করেন, ৯টি বারের যেকোটিতে গেলে পার্সেল হিসেবে মদ দেয়া হয়। কিন্তু সেই মদ হোটেলে যায় খোলাবাজারের বিষাক্ত মিথানল সংযুক্ত মদ। সঙ্গে দেয়া হয় ইয়াবাও। এ নিয়ে হোটেল-মোটেল জোনে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। যারা তা তৈরি ও সরবরাহ করছে।

রিফাত আরও জানায়, রেখে দেয়া আসল মদ বারে ফেরত দেয়ার সুযোগ রয়েছে। সে সুযোগে অতিরিক্ত টাকার লোভে অনেকে এই কাজ করছে বলেও জানায় সে। রিফাতের মতো আরও দুই ইজিবাইক চালকের কাছেও মিলেছে একই ধরণের তথ্য।

সৈকতের লাবনী পয়েন্টের বার ‘কয়লা’র ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান বিদ্যুৎ বলেন, লাইসেন্সধারীরাই বারে বসে মদ পান করার সুযোগ পান। পার্সেল কিংবা অনুমোদনহীন ব্যক্তি মদ পান না বলে দাবি তার।

একজন ব‍্যক্তি প্রতিদিন কি পরিমাণ মদ নিতে পারবেন জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বলেন, তার কাছে সেরকম কোন তথ্য নেই।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট (পর্যটন সেল) সৈয়দ মুরাদ ইসলাম এটি মানতে নারাজ।

তিনি বলেন, এক ঘেঁয়ে কর্মজীবন থেকে একটু ছাড় পেলেই পর্যটকদের স্বস্তির নিঃশ্বাসের জায়গার নাম, সমুদ্র নগরী কক্সবাজার। আর এসব পর্যটদের মাঝে অবৈধভাবে যারা মাদক তুলে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।