কক্সবাজারে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাদকের টাকা

সাহাদাত হোসেন পরশ •

পর্যটন নগরী কক্সবাজারের ভারুয়াখালীতে মো. হামিদের বাস। ছিলেন দর্জি, তাই ‘দর্জি হামিদ’ নামেই এলাকায় পরিচিত। এক দৌড়ে সম্পদের চূড়ায় ওঠার লোভে জড়িয়ে পড়েন মাদক কারবারে। ২০১৮ সালে চকরিয়ায় ৪০ হাজার ইয়াবাসহ ধরা পড়েন তিনি। দুই বছর কারাবাসের পর জামিনে বেরিয়ে আসেন।

এরপর গত নভেম্বরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রির ঘটনায় মো. হোসেন, লাল তন পাংখোয়া, মো. আলী আকবর ও আদিলুর রহমান নামে চারজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

চক্রটি অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করে বিক্রি করছিল। জবানবন্দিতে পুলিশকে তাঁরা অস্ত্রের নেটওয়ার্কের পাশাপাশি ইয়াবার একটি চক্রের কথাও জানান। চক্রটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন হামিদ।

অনুসন্ধানের একপর্যায়ে সিআইডির মানি লন্ডারিং ইউনিটের একটি সূত্রে জানা যায়, হামিদ কারাগার থেকে বেরিয়ে এবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনের মাধ্যমে ইয়াবা-রাজ্যে প্রবেশ করেন। সিআইডির ওই ইউনিট থেকেই মেলে হামিদের মাদক কারবারের বড় এক সহযোগীর নাম আর মোবাইল ফোন নম্বর; ভোলায় তাঁর বাস (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। হামিদের ওই সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগ ও সখ্য গড়ে তুলতেই কেটে যায় প্রায় তিন মাস। এরপর ধীরে ধীরে তাঁর কাছ থেকে জানা যায় হামিদের কুকীর্তির নানা চোরাপথ।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ডিজিটাল মাধ্যমে মাদকের জাল আরও শক্তিশালী করেছেন হামিদ। জেলায় জেলায় ইয়াবা কারবার চালাতে এজেন্টও আছে তাঁর। নিজের এলাকা কক্সবাজারের রহিম উল্লাহ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে মাদকের টাকা লেনদেন করেন তিনি। হামিদ বিভিন্ন এলাকায় মাদকের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করেন ০১৭৯৬৭২৪২৬৬ ও ০১৮৫১২১৭২৭৪- এ দুটি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে।

আর বিকাশের ০১৮৮২৯১৮২৭৬- এই ব্যক্তিগত নম্বর ব্যবহার করে ইয়াবা বেচাকেনার টাকা লেনদেন করছে এই চক্র। নম্বরটির টাকা লেনদেনের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট থেকে গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২ মাসে ৩১ লাখ ২৬ হাজার ১৯২ টাকা লেনদেন হয়েছে। মোট লেনদেন হয়েছে ৩৩৬ বার। গড় করলে একেকবারে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩০৪ টাকা ১৪ পয়সা।

অনুসন্ধান বলছে, মাদক কারবারি হামিদ বেশ ধুরন্ধর। সবকিছুতেই তাঁর নিখুঁত পরিকল্পনা। গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে তৈরি করেছেন জাল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। তিনি মাদক বেচাকেনার আলাপ চালাতেন ০১৭৯৬৭২৪২৬৬ নম্বর ব্যবহার করে, জাল কাগজপত্র দিয়েই তিনি ওই নম্বরের সিমকার্ডটি কেনেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিমকার্ড কেনার সময় হামিদ ছবি দিয়েছেন অন্যজনের। ছবিটি কক্সবাজার সদরের ঈদগাহ এলাকার গিয়াস উদ্দিনের। হামিদের আর্থিক নেটওয়ার্ক দেখভাল করেন যে রহিম উল্লাহ, তাঁর বিকাশ নম্বরটি (০১৮৮২৯১৮২৭৬) জাহেদা ইয়াসমিন নামের এক নারীর নামে নিবন্ধন করা। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ৭৩৪২৯৯০৮০৬।

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে হামিদ প্রথমেই প্রশ্ন করেন, ‘আপনি আমার নম্বর কোথায় পেলেন?’ মাদক কারবারের বিষয় তুললে তিনি বলতে থাকেন, ‘আপনে রং নম্বরে ফোন করেছেন। এলাকায় খোঁজ নেন। আমার মতো ভালো মানুষ কক্সবাজারে দুইটা খুঁজে পাবেন না। কে বলেছে, আমি মাদক কারবারি? কাজ করে ঘাম ঝরায়ে খাই। হামিদ নামে আরেক মাদক কারবারি আছে টেকনাফে। আপনাকে হয়তো কেউ বিভ্রান্ত করছে। কেন মাদক কারবারি হিসেবে আমার নাম আসবে? কেউ শত্রুতা করে আমাকে ফাঁসাচ্ছে। আমি সাদামাটা মানুষ, ভাই।’

এসব কথা বলে ফোন কেটে দেওয়ার পরই হামিদের দুটি সিমসহ বিকাশের নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে অনুসন্ধানের একপর্যায়ে হামিদের একাধিক ভয়েস রেকর্ড সমকালের হাতে আসে। এর একটিতে এক কারবারির উদ্দেশে হামিদকে বলতে শোনা যায়, ‘দু-এক দিনের মধ্যে তোদেরকে নতুন নম্বর দেব। আগের নম্বরে ফোন করিস না। এক সাংবাদিক আমার পিছে লাগছে। সব নম্বর জেনে গেছে। নতুন নম্বর পরে ফোন করে জানাব। মাল (ইয়াবা) কোথায় যাবে, তাও জানায়ে দেব।’

আরেকজনকে হামিদ বলছিলেন, ‘সুজন, মাল বিক্রির টাহাডা পাঠায়ে দিবি। পরে নতুন নম্বর দেব।’ পরে সুজনের নম্বর ০১৮৬৭৩৯২৮৪৭-তে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী। হামিদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি ইয়াবা কারবারি না।’

হামিদের সহযোগী রহিম উল্লাহকে ফোন করে মাদকের টাকা লেনদেনের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘বিকাশের নম্বরটি হায়াত আলী নামের আমার এক ভাইয়ের। এটি কিছুদিন ধরে আমি ব্যবহার করছি।’

‘ওই নম্বর দিয়ে মাদক কারবারের টাকা লেনদেন হচ্ছে’- কথাটি বলতেই রহিম উল্লাহ কোনো মন্তব্য না করেই ফোন কেটে দেন। এর পর থেকে নম্বরটি এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আর খোলা পাওয়া যায়নি।

খুঁজতে খুঁজতে রহিমউল্লাহর গ্রামে

কক্সবাজার সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ভারুয়াখালীর সওদাগরপাড়া। ওই গ্রামের উত্তরে চৌফলদণ্ডী-ভারুয়াখালী আর দক্ষিণে খুরুস্কুল নদী, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। ঘনবসতিপূর্ণ নির্জন গ্রামের সরু পথ ধরে গত ২১ সেপ্টেম্বর ওই পাড়ায় পৌঁছার পর স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া যায় রহিমউল্লাহর বাড়ির ঠিকানা। গ্রামের ভেতরে ছিমছাম একতলা বাড়ি। চারপাশে প্রাচীর। রহিম উল্লাহর মা জান্নাতুল ফেরদৌস ও তাঁর আরেক ছেলেকে পাওয়া গেল। তাঁরা জানান, ভারুয়াখালী বাজারে নিজের ইলেকট্রনিকস দোকানে আছে রহিম। ছুটলাম বাজারের দিকে।

ইলেকট্রনিকসের দোকানের পাশাপাশি ‘ইত্যাদি মোবাইল শপ’ রয়েছে তাঁর। বিকাশের এজেন্টও রহিম। ব্যক্তিগত বিকাশ নম্বর (০১৮৮২৯১৮২৭৬) থেকে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘দু-তিন বছর ধরে সিমটি খুঁজে পাচ্ছি না। এনআইডি করার সময় ওই নম্বরটি দিয়েছিলাম। আর সেই নম্বরের বিকাশের নিবন্ধন করা জাহেদা ইয়াসমিনের নামে। জাহেদা তাঁর প্রবাসী ভাই মনজুর আলমের স্ত্রী। তিনি গৃহিণী।’

‘এই বিকাশ নম্বরটি মাদক কারবারে ব্যবহার করেন হামিদ’- এমন প্রসঙ্গ তুললে রহিমউল্লাহ বলেন, ‘সেটা আমার জানা নেই। যদি কোনো মাদক কারবারি সেটা ব্যবহার করে, তাহলে সিমটি বাতিলের জন্য আবেদন করব।’

‘গত মাসে ফোন করা হলে আপনি বলেছিলেন, অল্প কিছুদিন হলো আপনি সিমটি ব্যবহার করছেন। আর আজ বলছেন, সিমটি দু-তিন বছর ধরে বেহাত’- কোনটা সঠিক? প্রশ্ন করতেই রহিমউল্লাহ এলোমেলো কথা বলতে বলতে দ্রুত দোকানের শাটার নামিয়ে তালা মেরে সটকে পড়েন।

মাদক-ব্যাংকিংয়ে বদির ভাইও
রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পরিবারের সদস্যরাও ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করছেন মাদক কারবারে। টেকনাফের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই ফয়সাল রহমান এই অপকর্মে জড়িয়েছেন।

বদি ও তাঁর ভাই পৌর কাউন্সিলর মজিবুর রহমানের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নেন। ফয়সাল এন্টারপ্রাইজের নামে নেওয়া লাইসেন্স নম্বর-৫৫৭। ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখায় একটি হিসাব খোলেন তিনি।

সিআইডির মানি লন্ডারিং ইউনিটের একটি নথিতে ফয়সালের ব্যাংকিং লেনদেন সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়, ‘ওই হিসাবে ফয়সাল মাদক বিক্রির ২ কোটি ৭৯ লাখ ৭৪ হাজার ২৩৭ টাকা লেনদেন করেছে। এই টাকার কোনো বৈধ উৎসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’

 

সমকাল/সিবিজে