কক্সবাজারে ৩ পর্যটকের মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল: সন্দেহের তালিকায় ইয়াবা বা আইস

বিশেষ প্রতিবেদক •

কক্সবাজারে ১৩ ঘন্টায় ২ তরুণী সহ ৩ পর্যটকের মৃত্যু ঘিরে তৈরী হয়েছে ধুম্রজাল। চিকিৎসকদের দাবি, ৩ টি মৃত্যুর মধ্যে এক তরুণী অতিরিক্ত মাদক সেবনের পাশাপাশি বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারি কিছু সেবন করেছে।

অপর ২ জনের মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া না গেলেও চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে মাদক এবং বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারি কিছু একটা সেবন করেছে বলে সন্দেহ করছেন। তবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসার পর বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে।

আর ৩ টি মৃত্যু ঘিরে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে এসেছে সঙ্গে আসা সঙ্গিদের নিয়ে। যেখানে কলেজ পড়ুয়া এক তরুণী এসেছিলেন ৪ বন্ধুর সাথে। অপর ২ জন স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিলেও তারা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন না। ইতিমধ্যে ২ তরুণীর অভিভাবকরা পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে হত্যা মামলা করেছেন। পুরুষ পর্যটকের পক্ষে স্বজনরা মামলা করতে রাজী না হওয়ায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার (১৮ মে) বিকালে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে মনিরুল ইসলাম ও লিজা রহমান ঊর্মি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন সী-গাল হোটেলের ৭২৪ নম্বর কক্ষে ঊঠেন। সেখানে রাত সাড়ে ১২ টার দিকে অসুস্থবোধ করলে পর্যটক মনিরুলকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে পৌঁছার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মনিরুল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় স্ত্রী পরিচয়ে সাথে থাকা নারীকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর নিশ্চিত হওয়া যায় তারা স্বামী-স্ত্রী নন। তবে কি সম্পর্কের জের ধরে এসেছিলেন তাও পরিষ্কার করে বলতে পারেনি পুলিশ।

এ ঘটনায় মনিরুল এর স্বজনরা কক্সবাজার আসলেও কোন ভাবেই মামলা করতে রাজী হননি। ফলে বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার সদর থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন।

মৃত্যুবরণকারি পর্যটক মো. মনিরুল ইসলাম (৪০) ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মাটিকাটাস্থ আব্দুল আজিজের ছেলে। পুলিশ জানিয়েছে, মো. মনিরুল ইসলামের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক না পেলে পুলিশ হত্যা মামলা হিসেবে নথিভূক্ত করবে। এর ফলে হোটেলে স্ত্রী পরিচয়ে অবস্থানকারি লিজা রহমান ঊর্মি (৩৫) নামের নারীকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিলেও মামলা দায়ের করার পর মুছলেখা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ।
এর আগে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হওয়া ২ তরুণীর অভিভাবক বাদি হয়ে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে পৃথক ২ টি মামলা দায়ের করেছেন। যার মধ্যে হোটেল বিচ হলিডে-তে অবস্থানকারি লাবণী আকতার (১৯) এর মৃত্যুর ঘটনায় তার পিতা মনির হোসেন বাদি হয়ে কক্সবাজার সদর থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

৪ বন্ধু সহ ১১ মে কক্সবাজার আসেন লাবণী। এসে কলাতলীর বীচ হলি ডে নামের একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান নেন। ওখানে ১৪ মে অসুস্থ হলে তরুণীকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ১৬ মে তাকে আইসিইউতে হস্তান্তর করা হয়। এসময় সঙ্গে আসা ৪ জনের মধ্যে ২ জন স্বীকার করেন তারা অতিরিক্ত মদ্যপান করেছিলেন। এ ঘটনায় ২ জনকে আটক করা হলেও অপর ২ জন পালিয়ে গেছে।

বুধবার (১৮ মে) দুপুরে লাবণী হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন। বৃহস্পতিবার সকালে তার পিতা মামলাটি দায়ের করেন। যেখানে ৪ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে যাত্রীবাড়ি এলাকার মো. জাহাঙ্গীরের পুত্র কামরুল আলম (২০) ও আবদুর রহমানের পুত্র আরিফ রহমান নিলু (২১) আটকের পর ৫৪ ধারায় কারা হেফাজতে রয়েছে।

পলাতক রয়েছে, শরিয়তপুর জেলার নুরিয়া এলাকার মোশারফ হোসেনের পুত্র তানজিল হাসান (২১) ও নারায়নগঞ্জ জেলার বাসিন্দা মাহিম হাসান অনিক (২০)। মামলার এজাহারে পিতা উল্লেখ করেন তার মেয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে বের হয়েছিল। অভিযুক্ত ৪ জন কৌশলে তার ৩ক কক্সবাজার এনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।

অপরদিকে, বধুবার সকালে গোপালগঞ্জের মাফুয়া খানম নামের নারীটি দিনাজপুরের নাছির উদ্দিন নামের যুবকের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে হোটেল রয়েল টিউলিপে উঠেন। দুপুরে খাবার শেষে দুইজনই নিজেদের কক্ষে অবস্থান নেন। এর কিছুক্ষণ পর নারীটির শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যার কথা অবহিত করা হলে তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে তারা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন না।

মাফুয়া খানম (২৯) মৃত্যুর ঘটনায় ভাই ছৈয়দুল ইসলাম বাদি হয়ে উখিয়া থানায় দায়ের করা মামলায় প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে তার বোনকে কক্সবাজার এনে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় নাছির উদ্দিন পুলিশের হাতে আটকও রয়েছে।

৩ পর্যটকের মৃত্যু নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজী নন চিকিৎসকরা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন চিকিৎসক জানান, হোটেল বিচ হলিডে-তে অবস্থানকারি লাবণী আকতারের মৃত্যুর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মদ্যপানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এক সঙ্গে বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারি কিছুও মিশানো হতে পারে মদে এমনটা সন্দেহ রয়েছে। একই সন্দেহ করছে অপর ২ পর্যটকের মৃত্যুর ক্ষেত্রেও।

চিকিৎসকদের দাবি, বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারি দ্রব্যটি মেথা অ্যামফিটামিন বা ক্যাফেইন মিশ্রিত কিছু বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ঢাকায় পাঠানো ময়না তদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর পরিষ্কার হওয়া যাবে। মেথা অ্যামফিটামিন বা ক্যাফেইন মিশ্রিত দ্রব্যের ক্ষেত্রে ইয়াবা বা আইস সেবনকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে চিকিৎসকরা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২ নারী সহ ৩ পর্যটক মৃত্যুর ঘটনাটি গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়েছে। ময়না তদন্তের পর মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে। এখন পর্যন্ত ২ নারীর পক্ষে দায়ের করা মামলা লিপিবদ্ধ হয়েছে। অপর পর্যটকের ব্যাপারে অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।