‘কঠোর পথ’ ছেড়ে সমঝোতার চেষ্টায় হেফাজত

রাজীব আহাম্মদ •

ধরপাকড়ের মুখে পড়ে ‘কঠোর পথ’ ছেড়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতা চালালেও কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ সংগঠনটির দাবি, তাদের ‘ভুল বোঝা’ হচ্ছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই তাদের। সরকারের বিরুদ্ধেও নন তারা।

সমঝোতাচেষ্টার অংশ হিসেবে হেফাজতের নেতারা এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানেও তারা একই দাবি করেছেন বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। তবে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের কয়েকজন জানিয়েছেন, এজাহারভুক্তদের গ্রেপ্তার এবং সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

সরকারের একটি অংশ মনে করে, বারবার ছাড় দেওয়ার কারণেই হেফাজত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তা ছাড়া সুশীল সমাজ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের শরিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও হেফাজতকে আর ছাড় না দেওয়ার জন্য চাপ রয়েছে।

গত সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতা। দুই বৈঠক সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পক্ষ বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। তবে হেফাজতের কয়েকজন নেতা সমকালকে বলেন, বৈঠকে কাঙ্ক্ষিত সমাধান না এলেও, পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। হেফাজত আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীও এরই মধ্যে সমঝোতার বার্তা দিয়ে নেতাকর্মীদের সহিংসতা থেকে দূরে থেকে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠকে হেফাজতে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী। ছিলেন মামুনুল হকের বড় ভাই এবং বেফাকুল মাদ্রাসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকসহ আটজন। মাহফুজুল হক সমকালকে বলেন, উভয়পক্ষের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো বৈঠকের আলোচনা নিয়ে প্রকাশ্যে বা গণমাধ্যমে কেউ কথা বলবেন না। তাই তিনি কিছু বলবেন না।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় হেফাজতের নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন বৈঠক নিয়ে। এরপর কয়েকজন নেতা সমকালকে বলেন, তিনটি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। সরকারের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনা, ধরপাকড় বন্ধ করা এবং মাদ্রাসাগুলো খুলে দিতে সরকারকে রাজি করা।

হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী সমকালকে বলেন, আলোচনা অব্যাহত আছে। গ্রেপ্তার ও হতাহত নেতাকর্মীদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারদের মুক্তির বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে।

‘সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে, ২৬ মার্চের ঘটনায় হেফাজতের কোনো সংশ্নিষ্টতা ছিল না,’ বলেন নুরুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষক ছাত্র মুসল্লি গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকেই এখানে-সেখানে আক্রান্ত হচ্ছেন। আট বছর আগের ২০১৫ সালের ৫ মে’র সহিংসতার মামলায় বিনা কারণে যাকে-তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। দেখা যাক সরকার কী করে।\হকয়েকজন নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় আলোচিত-সমালোচিত মামুনুল হক নেই। আজিজুল হক ইসলামাবাদী, জুনায়েদ আল হাবীবসহ অন্য নেতাদের মুক্তির বিষয়ে সরকারের কাছে আরজি জানালেও মামুনুল নেই হেফাজতের ভাবনায়।

হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা সমকালকে বলেন, আলোচনার মূল বিষয় ছিল ‘সরকারের ভুল ভাঙানো’।

তারা মন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অতিথি করার প্রতিবাদ করলেও, তার সফরের দিন কর্মসূচি রাখেনি। ২৪ মার্চ পুলিশের আলোচনা করে, ২৫ মার্চ বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ঢাকা মহানগর হেফাজত। মোদি ঢাকায় আসার দিনে ২৬ মার্চ হেফাজতে ইসলাম বা কোনো ইসলামী দলের কর্মসূচি ছিল না। তারপরও সেদিন কারা পুলিশবেষ্টিত বায়তুল মোকাররম থেকে মোদির সফরের প্রতিবাদে মিছিল করেছিল তা তদন্ত করা প্রয়োজন। ওই মিছিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নামে কারা হামলা করেছিল তাও তদন্ত প্রয়োজন।

হেফাজত নেতারা সরকারের প্রতিনিধিদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ২৬ মার্চ ‘তৃতীয় একটি পক্ষের’ মিছিলকে ঘিরে সহিংসতার কারণেই পরবর্তী সময়ে হাটাহাজারী ও ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব হয়েছে।

২৬ মার্চ বিকেলে হাটহাজারীতে যে মিছিল থেকে থানায় হামলা হয়েছে, তাতে মাদ্রাসাছাত্রদের অংশগ্রহণ থাকলেও হেফাজতের সিদ্ধান্তে ওই কর্মসূচি হয়নি। ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতা হয় স্থানীয় এমপির মিছিল থেকে জামিয়া ইউনিসিয়া মাদ্রাসা থেকে হামলার পর। নারায়ণগঞ্জের মামুনুলের রিসোর্টকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলার জন্য জাতীয় পার্টির স্থানীয় এমপির অনুসারী ও স্থানীয় রাজনীতির সমীকরণকে দায়ী করেছেন হেফাজত নেতারা। তবে ২৬ মার্চ বিকেলে হাটহাজারী থানায় ঢিল এবং ২৮ মার্চ ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়া ভাঙচুরে মাদ্রাসাছাত্র ও স্থানীয়রা জড়িত ছিল, এসব ঘটনা তাৎক্ষণিক ও সংগঠনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল বলে দাবি করেন তারা।

হেফাজত নেতারা বলেন, এসব সহিংসতা ও তাণ্ডবের ঘটনায় তাদের সরকারবিরোধী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ২০১৩ সালের ৫ মের সহিংসতার পর হেফাজত কখনও সরকারের বিরুদ্ধে যায়নি। ভবিষ্যতেও যাবে না। হেফাজত প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর সরকারের সঙ্গে তাদের একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বর্তমান নেতৃত্ব। এ কারণেই মোদির সফর নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাদের ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হয়েছে। ‘ভুল ভাঙাতে’ চলতি সপ্তাহের শুরুতে হেফাজত আমির টেলিফোনে কথা বলেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে।

হেফাজত নেতাদের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত নমনীয় হওয়ার কোনো নির্দেশ পাননি। মামলার এজাহারভুক্তদের গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকবে।

এরই মধ্যে সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা মহানগরের সহসভাপতি কোরবান আলী কাসেমী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ নিয়ে হেফাজতের ১২ জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো।

হেফাজতের সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা চলছিল সপ্তাহখানেক ধরে। তবে সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। রোববার মামুনুল হক গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাতে সোমবারের দুটি বৈঠকের সময়সূচি নির্ধারিত হয়।

মামলা গ্রেপ্তার ছাড়াও হেফাজতের জন্য বড় চাপ হলো মাদ্রাসা বন্ধ থাকা। গত বছর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও হাফেজি ও কওমি মাদ্রাসা খোলা ছিল। হেফাজতের নেতারা জানিয়েছেন, বন্ধ থাকলে মাদ্রাসাগুলো আর্থিক সংকটে পড়বে। কারণ রমজান ও কোরবানির সময় মাদ্রাসাগুলো সর্বোচ্চ দান, অনুদান পায়। এই অনুদানে বছরের বাকি সময় চলে।

হেফাজত নেতারা মনে করেন, তাদের আর্থিক জোগান বন্ধ করতেই সরকার মাদ্রাসা বন্ধ রেখেছে। তবে সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে মাদ্রাসা খোলার বিষয়ে কোনো আশ্বাসই পাননি হেফাজত নেতারা। সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত আলেম-ওলামার মাধ্যমে যোগাযোগ করিয়ে মাদ্রাসা খোলার অনুমতি পেতে চেষ্টা চলছে।