করোনার কারণে ঝুঁকিতে গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীরা

আবদুর রহমান ◑

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নিয়মিত চিকিৎসা ব্যহত হওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের হাজার হাজার গর্ভবতী নারী। হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় জন্মদানকালে শিশুমৃত্যুর অভিযোগও করেছেন রোহিঙ্গারা।

সরেজমিনে কক্সবাজারের কয়েকটি শরণার্থী শিবিরের ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। একদিকে করোনা সংক্রমণের ভয়, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়ায় হাসপাতালের পরিবর্তে ওষুধের দোকানদার কিংবা কবিরাজের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।

তবে সেখানকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন- হাসপাতালের সেবার মানে কোনও সমস্যা নাই, করোনার ঝুঁকির কারণে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা কমেছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত লেদা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চার বার চেকআপে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে বলে অভিযোগ ৯ মাসের গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারী নুর নাহারের (২০)।

এই নারীর অভিযোগ- এখন তার দুই পা ফুলে যায়, পেটে গ্যাস-এর সমস্যা করে। মাঝে মধ্যে পুরো শরীর প্রচণ্ড ব্যথা করে। ঠিক মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় এমন সমস্যা হচ্ছে। করোনাকালে পেটে বাচ্চা নিয়ে খুবই ভয়ে আছে বলেো জানায় সে।

টেকনাফের লেদা নতুন রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোস্তফা কামাল বলেছে, ‘বর্তমানে আমার ক্যাম্পের পাঁচ হাজার পরিবারে শতাধিক গর্ভবতী নারী রয়েছে। কিন্তু এই করোনাকালে হাসপাতালে গিয়ে দিনভর অপেক্ষার পরেও অনেকে চিকিৎসা পাচ্ছে না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে কেউ কেউ ওষুধের দোকানদারের চিকিৎসা নিচ্ছে। এই সময়ে সন্তান প্রসব করা ও নবজাতক লালন পালন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী, একজন প্রসূতি নারীকে প্রসবপূর্ব সময়ে চার বার চিকিৎসকের চেক-আপ করার কথা।’

করোনাকালে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা কমেছে বলে জানান, টেকনাফ লেদা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পের লোকজন ঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে আসে না। অনেকে ওষুধের দোকানদার, কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। যারা হাসপাতালে আসে, তারা শেষ অবস্থায় আসে।’

ডা. জাহাঙ্গীরের দাবি, করোনাকালেও গর্ভবতী নারীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হয়। এমনকি তাদের টিকা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা নিতে উদ্বুদ্ধ করছেন স্বাস্থ্য কর্মীরা।

আইওএমের স্বাস্থ্য বিভাগের টেকনাফের কোঅর্ডিনেটর নাঈ মা প্রু বলেন, ‘করোনাকালেও লেদা শরণার্থী শিবিরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী নারীসহ প্রতিদিন শতাধিক বিভিন্ন ধরনের রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর আগে প্রতিদিন আড়াইশ রোগী চিকিৎসা দেওয়া হতো।’

উল্লেখ্য,২০১৭ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়, যাদের বেশির ভাগ নারী এবং শিশু। বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে কক্সবাজারের ৩৪ শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসতি।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এর তথ্য মতে, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে এই সময়ে ৩ লাখ ১৮ হাজার পাঁচশ নারী ও মেয়ে গর্ভবতী হওয়ার সক্ষমতা রাখে। তবে চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৪টি ক্যাম্পে ৩১ হাজার ২শ’ গর্ভবতী নারী রয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারির পরে আর কোনোও জরিপ না হলেও করোনাকালে গর্ভবতীর সংখ্যা বেড়েছে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

টেকনাফের কয়েকটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা গর্ভবতী নারীদের নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ জার্মান সম্প্রীতি সংস্থা (বিজিএস)। সংগঠনটির টেকনাফের প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘টেকনাফের ২১, ২৩ ও ২৪ নম্বর ক্যাম্পে কাজ করছি আমরা। বর্তমানে এই তিনটি ক্যাম্পে এক হাজার একশ ৬৩ জন রোহিঙ্গা গর্ভবতী নারীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’ এছাড়া গত এক সপ্তাহে এসব ক্যাম্পে ৬১ শিশু জন্ম নিয়েছে বলেও জানান তিনি।

উখিয়ার কুতুপালংয়ের ক্যাম্প নেতা মোহাম্মদ রফিক বলেছে, তার শিবিরের ২০ হাজার পরিবারের বসবাস। সেখানে পাঁচশর বেশির রোহিঙ্গা নারী গর্ভবতী রয়েছে। এই করেনাকালে তারা ঠিক সময়ে চেকআপ ও চিকিৎসা পাচ্ছে না। কারণ অনেকে করোনার ভয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছে না। আবার অন্যদিকে চিকিৎসকরাও তেমন একটা সেবা দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

সন্তান হারিয়ে পঙ্গু মা

আইওএম পরিচালিত চিকিৎসা কেন্দ্রের অবহেলায় প্রসবকালে সন্তানের মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছেন লেদা শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা নারী ছেতেরা বেগম (৩০)। তিনি নিজেও পঙ্গু হয়ে ঝুপড়ি ঘরে পড়ে আছেন। ন্যূনতম চিকিৎসাও পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন।

ছেতারার স্বামী নুরুল ইসলাম বলেন, ছেতারা অসুস্থ বোধ করলে আইওএম পরিচালিত টেকনাফ লেদা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাই। এক সময়ে সেখানকার চিকিৎসক ও নার্সরা হাল ছেড়ে দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন- ভুল হয়ে গেছে, এই রোগীকে এখানে রাখা ঠিক হয়নি। ওই অবস্থায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজারে নেওয়া হলে সেখানে মৃত সন্তান প্রসব করে আমার স্ত্রী। এখন সে পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছে। কোথাও চিকিৎসা করার সুযোগ হয়নি। এমনকি লেদা স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও না।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইওএম, কক্সবাজারের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সমীর কুমার হাওলাদার বলেন, ‘কারো গাফিলতির কারণে গর্ভবতী সন্তান মারা গেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য সেবা খুবই স্বচ্ছ। সেখানে চিকিৎসায় অবেহলা হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের বিষয়ে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

করোনাকালে স্বাস্থ্য সেবায় কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তবে কোনও গর্ভবতী নারী যাতে সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ গর্ভবতী রোগীদের চিকিৎসা দিতে মানা করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশপাশি অন্য রোগীদেরও চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’