ক্রসফায়ারের’ বিবর্তন

ক্রসফায়ার’আর ‘বন্দুকযুদ্ধের’জায়গা দখল করেছে ‘হারকিউলিস’। মানবাধিকার কর্মীদের দাবি— এসব একই ধরনের ঘটনা। হয়তো দায় এড়ানোর জন্য এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেশি হওয়ায় এখন ধরন পরিবর্তন করে অন্য ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলকে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে—এগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ঘটছে না। তবে যেভাবেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটুক না কেন, এগুলো সর্বোচ্চ ফৌজদারি অপরাধ। এসব মামলার বাদী রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকেই বের করতে হবে এই হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত। তারা প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তেরও দাবি জানান।

গত বছরের মে থেকে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে। তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীরা একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’-এ নিহত হতে থাকে।

গবেষণা সেলের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের মে থেকে এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ও ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে ৩২০ জন। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সময়ে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনার বাইরেও গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি— দুই দল অপরাধীর মধ্যে গোলাগুলির কারণে নিহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার হতে দেখা যায় নি। যদিও এসব ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং কোনও আসামির নাম উল্লেখ না করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ।

বন্দুকযুদ্ধেনিহতের মামলায় আসামি গ্রেফতার হয় না

দুই দল অপরাধীর মধ্যে গোলাগুলিতে নিহতের ঘটনায় পুলিশ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতে দেখা যায়—গত এক বছরে বেশিরভাগ ঘটনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দুই গ্রুপ মাদক ব্যবসায়ীর’ মধ্যে গোলাগুলি, ‘ডাকাতের সঙ্গে ডাকাতের’ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ অথবা দুই গ্রুপ চরমপন্থীর মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছে। ২০১৮ সালের মে থেকে এখন পর্যন্ত এ ধরনের শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহতের সংখ্যাও শতাধিক।

পুলিশের দাবি, এসব ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ঘটেনি। কিন্তু হত্যার ঘটনাগুলোতে কারা জড়িত তা বের করতে পারেনি তারা।

গবেষণা সেলে সংরক্ষিত তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের মে থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই গ্রুপ অপরাধীর মধ্যে গুলিবিনিময়ে নিহত হয়েছে ১০৭ জন। এরমধ্যে পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ‘মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীর’ গোলাগুলিতে নিহত হয়েছে ৮৫ জন এবং ‘ডাকতের সঙ্গে ডাকাতের গুলিবিনিময়ে ২২ জন নিহত হয়েছে।

পুলিশের দাবি, এ ধরনের হত্যা মামলার আসামিদের না পেয়ে বা গ্রেফতার করতে না পেরে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

গত ২১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার সাতগ্রাম ইউনিয়নের পাঁচরুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলেন- লুৎফর রহমান মোল্লা (৪৫), মো. সবুজ সরদার (১৭), ফারুক হোসেন (৪০) ও জহিরুল ইসলাম (৩০)।

২২ অক্টোবর নিহত ফারুক হোসেনের বাবা জামাল উদ্দিন ছেলের লাশ শনাক্ত করতে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ‘ফারুকসহ চারজনকে ভুলতার গাউছিয়া থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।’ কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘দুই গ্রুপ ডাকাতের মধ্যে গোলাগুলিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে।’

এ ঘটনায় আড়াইহাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা আড়াইহাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ তিনি করেন, ‘ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় মামলার ঘটনা সত্য বলে প্রতীয়মান হলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামি বা সন্ত্রাসীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা যায়নি। তাই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করলাম। তবে ভবিষ্যতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অজ্ঞাতনামা আসামিদের সঠিক নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে।’

সব ঘটনা একই ধরনের কেবল নামের পরিবর্তন, দাবি মানবাধিকার কর্মীদের

মাদকবিরোধী অভিযানে নিহতের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনই এই প্রক্রিয়ার বৈধতা, উদ্দেশ্য এবং কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ ও উদ্বেগ জোরালো হচ্ছে। যে নামেই এই ‘মৃত্যু’ ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন, অনেকেই এ ধরনের মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ করছেন।

মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর বলেন, ‘এগুলো সবই একই ঘটনা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমানোর জন্য এখন অন্য কারণ বলা হচ্ছে।’

খুশি কবীর বলেন, ‘যেভাবেই বলা হোক না কেন, বিচারবহির্ভূত সব হত্যা একই। সংখ্যা বেশি হয়ে যাবে বলে এগুলো অন্যভাবে এখন জাতিসংঘসহ বাইরের রাষ্ট্রকে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এখানে বিচারবহির্ভূত হত্যা কম হয়—সেটা জাতিসংঘকে দেখানোর দরকার নেই। দেশের মানুষকে দেখানো উচিত দেশে কী হচ্ছে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে যদি কারও সঙ্গে গোলাগুলিতে খুনের ঘটনা ঘটে, তা তদন্ত করে সত্য উদঘাটনের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল।

তিনি বলেন, ‘এটা ফৌজদারি অপরাধ। রাষ্ট্র এ ঘটনার বাদী। রাষ্ট্রকেই বের করতে হবে এই হত্যাকাণ্ড কারা ঘটাচ্ছে।’

গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকার আশুলিয়ায় একটি ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি রিপনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর ৯ দিন পর ২৬ জানুয়ারি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলা থেকে সজল জমাদ্দার নামে এক তরুণের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। সে পাশের জেলা পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া থানার একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আসামি।

সাভারে নিহত রিপনের লাশের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি ধর্ষণ মামলার মূলহোতা।’আর  ঝালকাঠিতে নিহত সজলের লাশের সঙ্গে থাকা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার নাম সজল। আমি রহিমার (ছদ্মনাম) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’

রিপনের পরিবারের দাবি, সাদা পোশাকধারী কয়েকজন লোক পুলিশ পরিচয়ে  রিপনকে ধরে নিয়ে যায়। তবে গোয়েন্দা পুলিশ এ দাবি নাকচ করে।

অন্যদিকে, ১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১২টার দিকে রাকিব নামে আরেক তরুণের লাশ উদ্ধার করে ঝালকাঠির রাজাপুর থানা পুলিশ। সেও নিহত সজলের সঙ্গে মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণ মামলার আসামি ছিল। তার লাশের গলায় যে চিরকুটটি ছিল, তাতে হত্যার দায় স্বীকার করে লেখা ছিল গ্রিক দেবতা ‘হারকিউলিস’-এর নাম।

এই ‘হারকিউলিস তত্ত্ব’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। প্রশ্ন উঠেছে, এই বিতর্কিত ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে?

আইন ও সালিশ কেন্দ্র ২০১৮ সালের মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) সারা দেশে ক্রসফায়ারসহ ৪৬৬ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা জানায়।

আসক  তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যানের নিচে একটি নোট দিয়েছে। এতে তারা গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে বলেছে, ‘২৭ জন ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছে—দু-দল সন্ত্রাসী ও ডাকাতের মধ্যে গুলিবিনিময়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনার বেশিরভাগই গভীর রাতে ঘটেছে এবং পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করেছে।’

ক্রসফায়ার নিয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা রিটের শুনানি হয় না

২০০৬ সালের ২৫ মে সন্ত্রাসী টুন্ডা ইসমাইল ‘পুলিশ হেফাজতে’ কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়। ওই বছরই এ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করা হয়। আজ অবধি ওই রিটের ওপরে জারি করা রুলের জবাব দেয়নি বিবাদী পক্ষ। উদ্যোগ নেই শুনানিরও।

পরবর্তীতে ওই বছরের ৬ আগস্ট আরও একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এর তিন বছর পর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে আরেকটি রিট আবেদন দায়ের করা হয় ২০০৯ সালের ২৯ জুন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও কর্মজীবী নারী যৌথভাবে রিট আবেদনটি করে।

এই আবেদনেও হাইকোর্ট ক্রসফায়ার কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এছাড়া, মাদারীপুর সদর উপজেলার লুৎফর খালাসী ও খায়রুল খালাসী নামে দুই সহোদর ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনায় সুয়োমোটো রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে দুই সহোদরকে ক্রসফায়ারে হত্যা কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না ও দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

পরে ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি ওই রিটের নিয়ে শুনানি মুলতবি করা হয়। তারপর এ নিয়ে কোনও শুনানি হয়নি।

২০০৯ সালের ১৭ নভেম্বর বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান ও বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে আরও একটি রুল জারি করেন। এই রুলেরও শুনানি হয়নি।

এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘২০০৬ সালে জারি করা রুলের এখনও জবাব পাইনি। এ রুল শোনার জন্য এখতিয়ারসম্পন্ন কোর্ট পেলে শুনানির জন্য উপস্থাপন করবো।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ঘটনা মোটেও কাম্য না। যাদের সঙ্গেই ঘটুক, এই হত্যাকারী কারা, তাদের খুঁজে বের করা উচিত। তা না হলে অপরাধীরা এর সুযোগ নেবে। দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হবে।’

তিনি মনে করেন, ‘এভাবে অপরাধ দমন করা যাবে না।’

হত্যাকাণ্ডের পর ‘হারকিউলিসের’ দায় স্বীকারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘কোনও হত্যাকাণ্ডই সরকার বা রাষ্ট্রের কাম্য নয়। এই হারকিউলিসকে লাগিয়ে যারা হত্যা করছেন, আমি মনে করি তারাও ভালো কাজ করছেন না। আইনের হাতে তাদের সোপর্দ করা উচিত ছিল। এমন ঘটনা দুই-একটি যা ঘটেছে আমরা দেখছি, তদন্ত করে রহস্য উদঘাটন করা হবে।’

পুলিশের বক্তব্য

পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের বাইরে দু’গ্রুপ অপরাধীদের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের পর হত্যা মামলা হলেও অপরাধীরা কেন ধরা পড়ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলাগুলো তদন্তাধীন। তদন্তের পর আসলে হত্যাকারী কারা তা জানা যাবে। তদন্ত শেষ না হলে সুস্পষ্টভাবে কোনও কিছু বলা সম্ভব না।’

/বাংলা ট্রিবিউন