গত ১০ মাসে মাদকের ৮৪ হাজার মামলা

সরকারের জিরো টলারেন্স এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের পরও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার। সরকারের বিভিন্ন বাহিনী প্রতিদিন উদ্ধার করছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীদের। করা হচ্ছে মামলাও।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি), পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্ট গার্ড-এই পাঁচ সংস্থার নথিপত্রে দেখা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে মাদকের ঘটনায় ৮৩ হাজার ৬১১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এক লাখ চার হাজার ১৯৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেই হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে মামলা হয়েছে আট হাজার ৩৬১টি, আর আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে ১০ হাজার ৪২০ জন। এর আগে ২০২১ সালে গড়ে প্রতি মাসে সাত হাজার ৭৬৬টি মামলার বিপরীতে ১০ হাজার ১৭৯ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছিল।

kalerkanthoচলতি বছর গত বছরের তুলনায় ইয়াবা ও হেরোইন উদ্ধার কিছুটা কমলেও বেড়েছে গাঁজা, ফেনসিডিল, কোকেন, আফিম, ইনজেকটিং ড্রাগ, বিয়ার ও বিদেশি মদ উদ্ধার।

সরকারের পাঁচটি সংস্থার ১৩ বছর ১০ মাসের (২০০৯-২০২২) উদ্ধার করা মাদকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উদ্ধার করা ২৫ ধরনের মাদকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিদেশি মদ ও বিয়ার ইনজেকটিং ড্রাগ। এই সময় মামলা করা হয়েছে ৯ লাখ ৭০ হাজার ১৮৩টি আর আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫ জনকে।

চলতি বছর ১০ মাসে বেশি উদ্ধার হওয়া ৯ ধরনের মাদকের প্রচলিত বাজারমূল্য আনুমানিক এক হাজার ৯১৭ কোটি ৪৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬৭০ টাকা। সেই হিসাবে সংস্থাগুলো প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৯২ কোটি টাকার মাদক উদ্ধার করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক উদ্ধারের এই চিত্রই বলে দিচ্ছে, মাদকের বিস্তার কী পরিমাণ বেড়েছে।

গত ১৩ বছর ১০ মাসে পাঁচ সংস্থা মিলে উদ্ধার করেছে ৫০ কোটি ছয় লাখ ১৩ হাজার ৬৭৫ পিস ইয়াবা। এর মধ্যে সর্বাধিক পাঁচ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫ পিস উদ্ধার হয় ২০২১ সালে। হেরোইন উদ্ধার করা হয় তিন হাজার ২৫৮.৮০ কেজি। কোকেন উদ্ধার করা হয় ৫১.৫৭ কেজি।

২০০৯ ও ২০১৫ সালে আফিম উদ্ধারের ঘটনা না ঘটলেও ২০১৪ সালে ৯১.২২ কেজি আফিম উদ্ধার করা হয়েছিল। আর ১৩ বছর ১০ মাসে মোট আফিম উদ্ধার করা হয় ৩২৩ কেজি। গাঁজা উদ্ধার করা হয় সাত লাখ ২৮ হাজার ১১১ কেজি। এই সময় ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয় এক কোটি ২১ লাখ ৫০ হাজার ৯৪১ বোতল। লিটার হিসাবে উদ্ধার করা হয় ২২ হাজার ৮০৭ লিটার ফেনসিডিল। বিদেশি মদের বোতল উদ্ধার করা হয় ২৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪৬৯টি।

এই একই সময় ১৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৯৪ ক্যান বিয়ার এবং দুই লাখ ১৪ হাজার ৩০৫ বোতল বিয়ার উদ্ধার করা হয়। এই সময় ইনজেকটিং ড্রাগ (অ্যাম্পুল) উদ্ধার করা হয় ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪৪টি। সব মাদকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্ধার করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

ডিএনসির হিসাবে দেখা গেছে, সংস্থাটি চলতি বছরের ১১ মাসে ৪৫ লাখ ৬৪ হাজার ২৯৪ পিস ইয়াবা, ১২.৩৮ কেজি হেরোইন, আট হাজার ৮৪৬ কেজি গাঁজাসহ অন্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। এই সময় পরিচালনা করা হয় ৯৪ হাজার ৫৬৭টি অভিযান। মামলা করা হয় ২৩ হাজার ২৭০টি আর গ্রেপ্তার করা হয় ২৫ হাজার ৩০০ জনকে।

চলতি বছরে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে বিজিবি দুই হাজার ২৭ কেজি গাঁজা, পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার ২৪৫ পিস ইয়াবাসহ অন্য মাদক উদ্ধার করে। আগের তুলনায় উদ্ধারের এই পরিমাণ অনেক বেশি।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্র বলেছে, দেশে সংঘটিত বেশির ভাগ অপরাধের পেছনে রয়েছে মাদক। পারিবারিক নৃশংসতা, ধর্ষণের মতো ঘটনার পেছনেও রয়েছে মাদক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও মাদক নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে দেশে প্রায় ৮০ লাখ মাদকাসক্ত ব্যক্তি রয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মাদকসেবীদের বেশির ভাগ তরুণ। মাদক নির্মূল করে এই তরুণদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে মাদক কারবারের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে পরিবারে গড়ে তুলতে হবে সচেতনতা।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদক উৎপাদন, বিক্রয় ও সরবরাহকারী, এই জায়গাগুলো বন্ধ না করা না গেলে মাদকের বিস্তার কমানো যাবে না। মাদকের বিষয়ে যেভাবে গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন দরকার সেভাবে হচ্ছে না। কিছু মানুষ হতাশা ও অতি কৌতূহল থেকে মাদক সেবন করছে। আর সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, সেটি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ’

তিনি বলেন, ‘মাদকের চাহিদা থাকার কারণে বাড়ছে জোগান। আর যারা এটি নজরদারির (আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী) দায়িত্বে আছে, তারা নিজেরাই যদি এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে মাদকের জোগান বন্ধ করা কঠিন। জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক প্রলোভন, রাজনৈতিক চাপ এড়িয়ে দায়িত্ব পালনে আরো কঠোর হতে হবে। ’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘প্রতিদিনই মাদক ব্যবসায়ী ও সরবরাহকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। আমরাও সেভাবে অভিযান পরিচালনা করে মাদক উদ্ধারসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার করছি। ’

২০১৮ সালের ৪ মে ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ শিরোনামে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এরপর পুলিশসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরাও দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেন। সেই অভিযান শুরুতে কার্যকর হলেও বর্তমানে তা আর দৃশ্যমান নেই।

সূত্র: কালের কন্ঠ