ছুটি নেই বেতনেও টান, অতঃপর আত্মহত্যা!

ঢাকাপোষ্ট •

কেউ ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন, কেউ নিজের রাইফেলের গুলি নিজের গলায় চালিয়েছেন। এভাবে গত তিন বছরে বাংলাদেশ পুলিশের মোট ১৮ সদস্য আত্মহত্যা করেছেন। তাদের সবাই কনস্টেবল ও এসআই পদমর্যাদার। পুলিশ সদস্যদের আত্মহত্যার ঘটনায় স্ব স্ব ইউনিটে তদন্ত কমিটি হয়। তদন্তও হয়। তবে অধিকাংশ তদন্তের প্রতিবেদনে আত্মহত্যার কারণ বলা হয় ‘পারিবারিক কলহ’।

সঙ্গে কথা হয় ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। কথা হয় ভিন্ন ভিন্ন ইউনিটের কনস্টেবল ও এসআইদের সঙ্গে। সহকর্মীদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেওয়া মানসিক চাপ’-কে দায়ী করেন তারা। প্রায় প্রত্যেকের বর্ণনা একই রকম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কনস্টেবল বলেন, কনস্টেবল পদের চাকরি অনেক পরিশ্রমের। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হয় তাদের। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন। কেউ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বডিগার্ড, মালি এমনকি বাবুর্চি হয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। যারা নতুন নতুন কনস্টেবল হিসেবে চাকরিতে আসেন তাদের বয়স মাত্র ১৮ থেকে ২০ বছর। এত অল্প বয়সে অতিরিক্ত চাপ নিতে পারেন না তারা। একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

কনস্টেবলদের সঙ্গে কথা বলে ‘মানসিক চাপ’-এর বেশ কয়েকটি কারণ জানতে পেরেছে।

উচ্চহারে বেতনের কাটছাঁট

ঢাকা পোস্ট জানতে পেরেছে পুলিশ সদস্য আত্মহত্যা করার পর একটি তদন্ত কমিটি হয়। অধিকাংশ কমিটির প্রতিবেদনে ওই সদস্যের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ‘মানসিক চাপ’ বা ‘পারিবারিক চাপ’ ইত্যাদি দেখানো হয়।

কুমিল্লা জেলায় কর্মরত কনস্টেবল আব্দুর রহমান (ছদ্মনাম- ১) বলেন, পুলিশের প্রতিবেদনে চাপের কথা উল্লেখ থাকলেও এজন্য খোদ পুলিশের সিস্টেমই দায়ী। প্রতিটি মানুষ টাকার জন্য কাজ করে। পুলিশে আসার পেছনে ‘জনসেবা’ অন্যতম কারণ হলেও প্রধান কিন্তু অর্থ। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কনস্টেবলরা সবচেয়ে কম বেতন পান। অথচ প্রতি মাসে তাদের বেতনের মোটা একটা অংশ কেটে নেওয়া হচ্ছে।

রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়ে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের /ফাইল ছবি
পুলিশ সদরদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সদ্য যোগদান করা একজন কনস্টেবল ১৪ হাজার ৩০০ টাকা বেতন পান। সঙ্গে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা ভ্রমণ ভাতা দেওয়া হয়। তবে কনস্টেবলরা এ টাকার পুরোটা তুলতে পারেন না।

পুলিশের প্রতিবেদনে চাপের কথা উল্লেখ থাকলেও এজন্য খোদ পুলিশের সিস্টেমই দায়ী। প্রতিটি মানুষ টাকার জন্য কাজ করে। পুলিশে আসার পেছনে ‘জনসেবা’ অন্যতম কারণ হলেও প্রধান কিন্তু অর্থ। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কনস্টেবলরা সবচেয়ে কম বেতন পান। অথচ প্রতি মাসে তাদের বেতনের মোটা একটা অংশ কেটে নেওয়া হচ্ছে।

কুমিল্লা জেলায় কর্মরত কনস্টেবল আব্দুর রহমান (ছদ্মনাম- ১) পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংকে বিনিয়োগের জন্য প্রতি মাসে একজন কনস্টেবলের কাছ থেকে দুই হাজার করে টাকা কাটা হয়। এছাড়া পুলিশের শপিং মল তৈরির জন্য এককালীন ১০ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। পুলিশের কল্যাণ তহবিলের জন্য প্রতি মাসে ৫০ টাকা করে কাটা হয়। তবে প্রতি বছরের জুলাই ও ডিসেম্বরে কাটা হয় ১১০০ টাকা করে। কাটা হয় সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিলের (জিপিএফ) জন্য অর্থ। কনস্টেবলদের ভ্রমণভাতা আগে কমপক্ষে ২০০০ টাকা ছিল, বর্তমানে তা ‘শূন্য’।

২০১৯ সালে কনস্টেবল পদে যোগ দেওয়া জাহাঙ্গীর আলম (ছদ্মনাম- ২) জানান, আমার ১৪ হাজার ৩০০ টাকার বেতন থেকে কমিউনিটি ব্যাংকে বিনিয়োগ, শপিং মল তৈরির চাঁদা, সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা কেটে নেওয়া হয়। এগুলো কাটার পর প্রায় ৮৩০০ টাকার মতো থাকে। এ টাকার একটা অংশ আবার বাড়িতে পাঠাতে হয়। ফলে যা থাকে তা দিয়ে নিজে চলব কীভাবে, পরিবারকেই বা দেব কী? সামনে সাত বিভাগীয় শহরে পুলিশ কলেজ ও হাসপাতাল তৈরির জন্য টাকা নেবে বলে জানানো হয়েছে। কলেজ তৈরির জন্য চাঁদার পরিমাণ এককালীন ২০ হাজার টাকা হতে পারে। হাসপাতাল তৈরির জন্য আরও বেশি টাকা নেওয়া হবে বলে সিনিয়ররা জানিয়েছেন। এমন হলে তো হাতে কোনো টাকাই থাকবে না!

পুলিশের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ‘পারিবারিক কলহ’ বলা হলেও অত্যধিক ‘মানসিক চাপের’ কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে— বলছেন ভুক্তভোগীর পরিবার
পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংকে বিনিয়োগের জন্য প্রতি মাসে একজন কনস্টেবলের কাছ থেকে দুই হাজার করে টাকা কাটা হয়। এছাড়া পুলিশের শপিং মল তৈরির জন্য এককালীন ১০ হাজার টাকা, পুলিশের কল্যাণ তহবিলের জন্য প্রতি মাসে ৫০ টাকা, প্রতি বছরের জুলাই ও ডিসেম্বরে কাটা হয় ১১০০ টাকা করে। এছাড়া জিপিএফের জন্য কাটা হয় টাকা।

২০১৬ সালে কনস্টেবল পদে যোগ দেওয়া আজিজুর রহমান (ছদ্মনাম- ৩) বলেন, পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংকের জন্য আমরা যে ২০০০ টাকা করে মাসিক চাঁদা দিলাম, সেটাকে আমাদের বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়েছে। তবে এ টাকা বিনিয়োগ করে কত বছরে কত টাকা সুদ বা মুনাফা হিসাবে পাব, এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এতে আমাদের মতো অল্প বেতনের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।এসব সিদ্ধান্ত প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করছে।

ছুটির জন্য ঘুরতে হয় দ্বারে দ্বারে

পুলিশ সদস্যরা জানান, বর্তমানে পুলিশ সদস্যরা বছরে ২০ দিন ক্যাজুয়াল লিভ (সাধারণ ছুটি) পান। এছাড়া ৩৫ দিন আর্ন লিভ (অর্জিত ছুটি) রয়েছে তাদের। তবে এত ছুটি থাকলেও বছরে সাত দিনের ছুটি কাটানোর সুযোগ পান না অনেকে। পুলিশের কোনো ইউনিটেই কনস্টেবল-এসআইরা প্রাপ্য ছুটি পান না। ছুটির জন্য ঘুরতে হয় দ্বারে দ্বারে।

পুলিশ লাইনে কর্মরত এক পুলিশ সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবার অসুস্থতার কারণে মেজর অফিসে সাত দিনের ছুটির জন্য আবেদন করি। সেখান থেকে রিজার্ভ ইন্সপেক্টর ও সংশ্লিষ্ট ছুটি শাখার কর্মরত অফিসারের কাছে পাঠানো হয় আমাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘করোনার কারণে ছুটি বন্ধ’ বলে আমাকে ছুটি দেওয়া হয়নি। ছুটির জন্য একজনের সঙ্গে তর্ক করলে আমাকে সরাসরি পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে যেতে বলা হয়। তবে আমার সাহস হয়নি। ছুটি কাটাতে পারিনি।

আমার ১৪ হাজার ৩০০ টাকার বেতন থেকে কমিউনিটি ব্যাংকে বিনিয়োগ, শপিং মল তৈরির চাঁদা, সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা কেটে নেওয়া হয়। এগুলো কাটার পর প্রায় ৮৩০০ টাকার মতো থাকে। এ টাকার একটা অংশ আবার বাড়িতে পাঠাতে হয়। ফলে যা থাকে তা দিয়ে নিজে চলব কীভাবে, পরিবারকেই বা দেব কী।

কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলম (ছদ্মনাম- ২)
কক্সবাজারের একটি থানায় কর্মরত এক এসআই বলেন, সর্বশেষ ২০২০ সালের জুন মাসে ছুটি কাটিয়েছিলাম। এরপর জুলাই মাসে ঈদের ছুটি চাইলে আমাকে দেওয়া হয়নি। ঈদের পর ছুটি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। থানার একজন কর্মকর্তাকে ছুটি নিতে হলে ইন্সপেক্টর তদন্ত, থানার ওসি, সার্কেল অফিস, ছুটি শাখার অফিসার ও পুলিশ সুপারের অনুমতি লাগে। প্রথম ধাপ থেকেই আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ছুটি দেওয়া হবে না। নয় বছরের চাকরির জীবনে আমি মাত্র পাঁচ ঈদে ছুটি পেয়েছি। বাবা ও মা মারা যাওয়ার সময় দুবার ছুটি পাই। এছাড়া কোনো ছুটি দেওয়া হয়নি।

ছুটি চাইলেই সিনিয়র গালমন্দ করেন, বহুবার কেঁদেছি।

ডিএমপির একটি থানার এক এসআই বলেন, এ বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অসুস্থতার কারণে করোনা টেস্ট করাই। ফলাফল নেগেটিভ আসে। তবে শরীর ভালো ছিল না আমার। কাশি আর সর্দি ছিল। ছুটি চেয়েছিলাম। করোনা নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও আমি বিভাগের সিনিয়র অফিসারের কাছে কেন ছুটি চাইতে গেলাম, সেজন্য তিনি আমাকে গালমন্দ করেন। সইতে না পেরে বের হয়ে একাই কেঁদেছি।

তিনি বলেন, নিয়মিত ডিউটি করে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। এমনও দিন যায় টানা ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। এরপর আর মাথা ঠিক থাকে না। নিয়মিত এভাবে ডিউটি করতে করতে আমরা হতাশ হয়ে পড়ছি। যারা পারছে মানিয়ে নিচ্ছে, যারা পারছে না আত্মহত্যা করছে।

এ বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অসুস্থতার কারণে করোনা টেস্ট করাই। ফলাফল নেগেটিভ আসে। তবে শরীর ভালো ছিল না আমার। কাশি আর সর্দি ছিল। ছুটি চেয়েছিলাম। করোনা নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও আমি বিভাগের সিনিয়র অফিসারের কাছে কেন ছুটি চাইতে গেলাম, সেজন্য তিনি আমাকে গালমন্দ করেন। সইতে না পেরে বের হয়ে একাই কেঁদেছি। নাম প্রকাশ না করে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট থানার এক এসআই

তিনি আরও বলেন, পুলিশে আত্মহত্যা করা সদস্যদের অধিকাংশেরই চাকরির বয়স এক থেকে তিন বছর। অল্প বয়সে এত চাপ তারা নিতে পারছেন না। এছাড়া দিনদিন এটি বাড়ার কারণ হচ্ছে যার অধস্তন থেকে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে, তাকে তার দায় নিতে হয় না। যে পুলিশ সদস্য আত্মহত্যা করেছেন তিনি সর্বশেষ কবে ছুটিতে গিয়েছিলেন, ছুটির জন্য কার কাছে কতবার ঘুরেছেন— এসব বিষয় যদি তদন্ত করে বের করা যেত এবং জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেত তাহলে আত্মহত্যা আর হতো না।

ওসির ছুটি না পেয়ে চিরতরে চলে যান হাসান আলী

আত্মহত্যা করা বেশ কয়েকজনের পরিবারের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তাদের একজন পাবনার আতাইকুলা থানার এসআই হাসান আলী। চলতি বছরের ২১ মার্চ হাসান আত্মহত্যা করেন। সেদিনই তার বাবা আব্দুল জব্বারের সঙ্গে কথা হয় । সেসময় তিনি বলেছিলেন, বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পাঁচ দিনের ছুটির আবেদন করেছিল হাসান। পাবনার পুলিশ সুপার (এসপি) ছুটি মঞ্জুর করলেও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম তাকে ছুটিতে যেতে দেননি।

যে পুলিশ সদস্য আত্মহত্যা করেছেন তিনি সর্বশেষ কবে ছুটিতে গিয়েছিলেন, ছুটির জন্য কার কাছে কতবার ঘুরেছেন— এসব বিষয় যদি তদন্ত করে বের করা যেত এবং জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেত তাহলে আত্মহত্যা আর হতো না।

নাম প্রকাশ না করে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট থানার এক এসআই আব্দুল জব্বারের সঙ্গে ফের ১৯ আগস্ট কথা হয়। ফোনে আপ্লুত বাবা কোনোভাবেই কথা বলতে পারছিলেন না। ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করাতেই কেঁদে ওঠেন তিনি। পরে সঙ্গে কথা হয় হাসানের চাচি শাহিদা বেগমের।

তিনি বলেন, আমাদের যৌথ পরিবার। সবাই একসঙ্গে থাকি। গোটা পরিবারে দুই ছেলের মধ্যে হাসান একজন। আত্মহত্যার আগের দিন ২০ মার্চ রাতে হাসানের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। সে বলে, চাচি এসপি সাহেব পাঁচ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছেন। তবে থানার আরও কয়েকজন অফিসার বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছুটিতে থাকায় ওসি তাকে ছুটি দেননি। পরের দিনই হাসানের লাশ আসে বাসায়।

তিনি বলেন, আমাদের ছেলের মৃত্যুর একমাত্র কারণ তাকে পরীক্ষার সুযোগ না দিয়ে মানসিক চাপ দেওয়া। ওসির একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা ছেলে হারালাম। হাসানের বাবা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কীভাবে বেঁচে আছি, আমরাই জানি!

চলতি বছরের ২১ জুলাই ঈদুল আজহার দিন নিজের রাইফেলের গুলিতে মেহেরপুরের পুলিশ কনস্টেবল সাইফুল ইসলাম আত্মহত্যা করেন। সাইফুলের পরিবারের দাবি, দীর্ঘদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় তার মধ্যে হতাশা ছিল। এছাড়া নানাবিধ জটিলতার মধ্যে ছিলেন তিনি।

ছুটি না পেয়ে আত্মাহুতির শুরুটা মেহেরপুরে

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর জেলার কামাল হোসেন চৌধুরী (৪৫) নামের এক কনস্টেবল আত্মহত্যা করেন। চার বছর পর সঙ্গে কথা হয় কামালের বোন সীমা চৌধুরীর। তিনি বলেন, কামাল দীর্ঘদিন ধরে মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভুগছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার জন্য ছুটি চেয়েছিল। কিন্তু তাকে ছুটি দেওয়া হয়নি। আমাদের বেশ কয়েকবার হতাশার কথা জানিয়েছে সে। হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করে কামাল।

আমাদের ছেলের মৃত্যুর একমাত্র কারণ তাকে পরীক্ষার সুযোগ না দিয়ে মানসিক চাপ দেওয়া। ওসির একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা ছেলে হারালাম। হাসানের বাবা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কীভাবে বেঁচে আছি, আমরাই জানি। আত্মাহুতি দেওয়া এসআই হাসানের চাচি শাহিদা বেগম

ছুটি পান না ঊর্ধ্বতনরাও

পুলিশের বেশ কয়েকজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডিশনাল এসপি) ও সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) সঙ্গে কথা হয় । তারা জানান, শুধু নিম্ন স্তরে নয়, এএসপি থেকে এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তারাও ছুটি কাটাতে পারেন না।

একটি মেট্রোপলিটন শহরের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) বলেন, বারবার বিভাগীয় উপ-কমিশনারকে (ডিসি) বলেও গত চার ঈদের একটিতেও ছুটি পাইনি। দুই বছরে একবার সাত দিনের ছুটিতে গিয়েছি। তবুও অফিসের সঙ্গে ফোনে সার্বক্ষণিক যুক্ত ছিলাম।

তিনি বলেন, পুলিশে ‘রেস্ট অ্যান্ড রিক্রেশন লিভ’ নামে একটি ছুটি রয়েছে। তিন বছর পরপর ১৫ দিনের এ ছুটি পাই আমরা। কিন্তু চাকরিজীবনের আট বছরেও সেই ছুটি কাটানোর সুযোগ পাইনি।

আত্মহত্যার প্রতিটি ঘটনাই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্তসাপেক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তের ফাইন্ডিংস অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়— পুলিশ সদরদফতর

‘চাপে’ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন যারা

গত তিন বছরে আত্মহত্যা করা সদস্যরা হলেন- মেহেরপুর জেলা পুলিশের কনস্টেবল কামাল হোসেন চৌধুরী, ময়মনসিংহের গৌরীপুর থানার কনস্টেবল হালিমা আক্তার, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার রতনপুর পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল সাইফুল ইসলাম, বরিশাল পুলিশ লাইনের কনস্টেবল হৃদয় দাস, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের বাংলোতে কর্মরত কনস্টেবল মেহেদী হাসান, মিরপুর ১৪ নম্বর পুলিশ লাইনের নায়েক শাহ মোহাম্মদ কুদ্দুস, রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক বাসভবনের পুলিশ ব্যারাকে কর্মরত কনস্টেবল বাবুল হোসেন, রাঙ্গামাটির কনস্টেবল কাইয়ুম সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ ব্যারাকের কনস্টেবল তাসলিমা আক্তার, রাজশাহী মহানগরীর এয়ারপোর্ট থানার কনস্টেবল মিতা খাতুন, টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনের কনস্টেবল শারমিন আক্তার, কিশোরগঞ্জ পুলিশ লাইনের কনস্টেবল রবিউল আউয়াল, ঢাকার পুলিশ কন্ট্রোল রুমের (পিসিআর) কনস্টেবল সুধাংশু কুমার বিশ্বাস, ঝালকাঠির কনস্টেবল নাদিয়া আক্তার, বগুড়ার ধুনট থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রোজিনা খাতুন, পাবনার আতাইকুলা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হাসান আলী, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার এসআই রোকনুজ্জামান।

আত্মহত্যার বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর যা বলছে

অধস্তন সদস্যদের বেতন কাটা নিয়ে অসন্তোষ, ছুটি না দেওয়াই আত্মহত্যার মূল কারণ। সদস্যদের চাপমুক্ত রাখার বিষয়ে পুলিশ সদরদফতরের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চায়। উত্তরে পুলিশ সদরদফতর জানায়, আত্মহত্যার প্রতিটি ঘটনাই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্তসাপেক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তের ফাইন্ডিংস অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

অধস্তনদের তিরস্কার না করে সমস্যার সমাধান করতে হবে

নানা চাপে পুলিশ সদস্যদের আত্মহত্যার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, দেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় পুলিশ সদস্যদের সংখ্যার অনুপাত অনেক কম। পুলিশে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাবলের (কনস্টেবল/এসআই) যারা, তাদের পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের চাপ নিতে হয়। পেশাগত ব্যস্ততার কারণে তারা পরিবারের প্রয়োজনে কখনওই শতভাগ সাড়া দিতে পারেন না। একে তো সারাদিন পরিশ্রম, স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে না পারা, সার্বক্ষণিক ঝুঁকি নিয়ে চাকরি, ঊর্ধ্বতনদের তিরস্কার, ক্যারিয়ার-ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে চিন্তা— এসব চাপ নিতে না পেরে একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তারা।

প্রথমেই পুলিশের লোকবল বাড়াতে হবে। এছাড়া পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে তার অবস্থা, যোগ্যতা ও পদমর্যাদা অনুযায়ী গুরুত্ব দিতে হবে। পুলিশের ঊর্ধ্বতনদেরও তাদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। একটি ইউনিটে যারা প্রধান থাকেন তাদের উচিত অধস্তনদের কথাগুলো শোনা। ধমক দিয়ে, তিরস্কার করে কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান হয় না। সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক

তিনি আরও বলেন, এসব পদমর্যাদার (কনস্টেবল/এসআই) কর্মীদের জন্য খাবার, পুষ্টি, বিনোদন নিয়ে আমরা খুব একটা মনোযোগ দিই না। পুলিশ প্রশাসনও মনোযোগী না। শুধু পুলিশেই নয়, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি চাকরিতে ঊর্ধ্বতনরা ক্ষমতা, নিরাপত্তা, বিনোদনের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। নিচের পদের লোকজনের এসব চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

আত্মহত্যার সমাধান জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমেই পুলিশের লোকবল বাড়াতে হবে। এছাড়া পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে তার অবস্থা, যোগ্যতা ও পদমর্যাদা অনুযায়ী গুরুত্ব দিতে হবে। পুলিশের ঊর্ধ্বতনদেরও তাদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। একটি ইউনিটে যারা প্রধান থাকেন তাদের উচিত অধস্তনদের কথাগুলো শোনা। ধমক দিয়ে, তিরস্কার করে কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান হয় না।

পুলিশের বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই : সাবেক আইজিপি

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশে একদমই ছুটি না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে করোনাকালীন পুলিশ সদস্যদের ডিউটি বেশি করতে হয়েছে, তাই হয়তো ছুটি দেওয়া যায়নি।

পুলিশ সদস্যরা কেন আত্মহত্যা করছেন, সেটা কেস টু কেস ভিন্ন হতে পারে। তবে চাপমুক্ত থাকার জন্য পুলিশ সদস্যদের অবশ্যই বিনোদনের ব্যবস্থা দরকার
সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক
পুলিশের চাপ নেওয়া এবং চাপ কমানোর জন্য বিনোদনের ব্যবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা কেন আত্মহত্যা করছেন, সেটা কেস টু কেস ভিন্ন হতে পারে। তবে চাপমুক্ত থাকার জন্য পুলিশ সদস্যদের অবশ্যই বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। পুলিশ লাইনে যারা থাকেন তাদের জন্য ইনডোর গেমের ব্যবস্থা থাকে।

পুলিশের সাংস্কৃতিক সংগঠনও আছে। অনেক পুলিশ সদস্য সেখানে শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। করোনা মহামারির কারণে এগুলো হয়তো বন্ধ রয়েছে। সারাদিন ডিউটির পর একজন পুলিশ সদস্যের যে পরিমাণ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা দরকার, সেটি নেই আমাদের। সূত্র ঢাকাপোষ্ট