জাতিসংঘের প্রস্তাবে নেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন, আবারও হতাশ কক্সবাজারবাসী


ইউএনএইচসিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নতুন করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৩ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে।

এর আগে ৩৭ হাজার ২১৬ পরিবারের এক লাখ ৫০ হাজার ৬৯৮ রোহিঙ্গার বসতি ছিল। এখন ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ রোহিঙ্গার বসতি। এর মধ্যে শূন্য থেকে ৪ বছরের ৭০ হাজার ৭২৪ জন মেয়েশিশু, ৫ থেকে ১১ বছরের ৬১ হাজার ৮৮৩ জন ছেলেশিশু, ৯৭ হাজার ২৪৪ মেয়ে, ৯২ হাজার ৮২৪ জন ছেলে। এ ছাড়া ১২ থেকে ১৭ বছরের ৫৩ হাজার ৪২ জন মেয়ে এবং ১৮ থেকে ৫৯ বছরের মেয়ের সংখ্যা এক লাখ ৫৯ হাজার ১২৭ জন, ১৭ শতাংশ পুরুষ এক লাখ ৫০ হাজার ২৮৭ জন। ৬০ বছরের বেশি বয়সী নারী ১৭ হাজার ৬৮০ জন, পুরুষ ১৭ হাজার ৬৮০ জন।

মিয়ানমারের সাথে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ভেস্তে যাচ্ছে। সর্বশেষ ১৯ জুন জাতিসংঘের প্রস্তাবে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া ১২লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিয়ে দিক-নির্দেশনা না থাকায় গভীর হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ও কক্সবাজার জেলাবাসী।কারণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে কেন্দ্র করে ইয়াবা পাচারকারী, সন্ত্রাসী ও মানবপাচারকারীসহ সমাজবিরোধী চক্রের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

১৯ জুন শুক্রবার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সাধারণ জনগণের ওপর প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এতে ১১৯টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। বেলারুশ এর বিরুদ্ধে ভোট দেয়। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান, লাওস, থাইল্যান্ড, রাশিয়াসহ ৩৬টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।

প্রস্তাবে মিয়ানমারে গত ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিকদের মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রস্তাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রতি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের সব সদস্যদেশের প্রতি মিয়ানমারে অস্ত্র যাওয়া প্রতিরোধে কাজ করতে আহ্বান জানানো হয়।

এ বিষয়ে ভোটদানে বিরত থাকার কারণ ব্যাখ্যায় শনিবার মিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর একটি কোর গ্রুপ এ প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে।

জাতিসংঘের প্রস্তাবে নেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন, হতাশ বাংলাদেশ

প্রস্তাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো সুপারিশ বা পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, স্থায়ীভাবে ও মর্যাদার সঙ্গে স্বভূমিতে ফেরত যাওয়ার জন্য রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথাও এখানে বলা হয়নি। রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব মৌলিক বিষয় প্রস্তাবে উঠে না আসায় বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

এদিকে জাতিসংঘের প্রস্তাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে কোন দিক-নির্দেশনা না থাকায় হতাশ প্রকাশ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন,এর ফলে উখিয়া-টেকনাফের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনদিন নিয়ন্ত্রণের আরও বাইরে চলে যাবে।এরই মধ্যে রোহিঙ্গারা মাদক ইয়াবা,আইস ও মানব পাচারে মারাত্বকভাবে জড়িয়ে পড়েছে।তাদের অত্যাচারে সীমান্তের স্থানীয়দের মাঝে হতাশা তৈরি হচ্ছে।

কক্সবাজার চেম্বার সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির অপচক্রে পড়ে রোহিঙ্গা সমস্যা দিনদিন প্রকট হয়ে ওঠছে। বিচক্ষনতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা না গেলে সমস্যার আশু সমাধান আশা করা যাবে না।

বাংলাদেশের সীমান্ত জেলা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ শুরু হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। তখন আসা তিন লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে আড়াই লাখ শরণার্থী মিয়ানমার পরে ফিরিয়ে নিয়েছিল। ১৯৯২ সালে আসে দুই লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৭ জন শরণার্থী।

এর মধ্যে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়েছে দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে। ফলে প্রতিবারই কিছু রোহিঙ্গা কক্সবাজারে থেকে গেছে।

১৯৯২ সালের পর আরও বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গারা এলেও তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উদ্যোগ আর দেখা যায়নি। এরপর থেকে প্রত্যাবাসন বন্ধ হয়।

২০১২ সালের ৩ জুন মিয়ানমারে তাবলিগ জামাতের ওপর হামলা চালায় রাখাইনরা। সে সময় সংর্ঘষ শুরু হয়। সংঘর্ষ মংডু থেকে আকিয়াব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ওই পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে পালানো শুরু করে রোহিঙ্গারা। তাদের অনেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যের সীমান্তে পুলিশের ছাউনিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য হতাহত হয়। তখন মিয়ানমার সরকার দাবি করে, এ হামলার সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত। পরদিন রাতে হঠাৎ মিয়ানমারের সেনারা সন্ত্রাসী দমনের নামে রোহিঙ্গাদের গ্রাম ঘিরে ধরপাকড়, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করে। ওই সময় ৭৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

সবশেষ ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ২৪টি সীমান্ত চৌকিতে একযোগে হামলা হয়। আবারও শুরু হয় অপরাধী দমনের নামে অভিযান। পর দিন ২৫ আগস্ট থেকে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। তাতে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় উখিয়া-টেকনাফে।

প্রায় ১৬ বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ থাকার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি নতুন সমঝোতা স্মারকে একমত হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। চুক্তিতে দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত যেতে পারেনি।

এ সুযোগে কক্সবাজার সদরসহ ৮ উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া, পটিয়া, বাঁশখালী, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম মহানগরীর ডাবলমুরিং, কোতোয়ালী, চান্দগাঁও। বান্দরবানের সদর, নাইক্ষ্যংছড়ি ও লামা, রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু, খাগড়াছড়ির দুর্গম অঞ্চলের উপজেলাসমূহে উল্লেখযোগ্যহারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা প্রথমে জন্মনিবন্ধন, পরবর্তীতে এনআইডি এবং আরও পরে পাসপোর্ট পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে।ইতিমধ্যে ৫৫ হাজার ৩১০ রোহিঙ্গার এনআইডি পেয়ে যাওয়ার ঘটনাও উদঘাটিত হয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে ৯৮ হাজার রোহিঙ্গা এনআইডি হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের যে ঢল নামে তাদের প্রথম আশ্রয় হয় উখিয়া টেকনাফে। সেখান থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে এরা দেশের অসংখ্য জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

তন্মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা, পার্বত্য বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি জেলায় সবচেয়ে বেশি। দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বাংলাদেশী নাগরিকদের নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে প্রথমে উপজেলা চেয়ারম্যান, মেট্রো অঞ্চলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসসমূহ থেকে জন্মনিবন্ধন কার্ড হাতিয়ে নেয়ার পর ইসি থেকে পেয়ে যাচ্ছে এনআইডি।

এরপরে যার যার প্রয়োজনে নিচ্ছে পাসপোর্ট। চলে যাচ্ছে বিদেশে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে। এ জাতীয় রোহিঙ্গা বাংলাদেশী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে সৌদি আরবেই বেশি।