টেকনাফে দুই ভাইয়ের ক্ষমতার নেপথ্যে

আবদুল আজিজ, বাংলা ট্রিবিউন •

কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিনকে সাড়ে ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আটক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সঙ্গে তার সাবেক ইউপি সচিব রিয়াজুল আলমকেও আটক করা হয়েছে। তবে শুধু দুর্নীতি নয়, মাদক কারবার ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে আজিজ উদ্দিন ও তার ভাই মৌলভী রফিক উদ্দিনের বিরুদ্ধে। আজিজ কারাগারে থাকলেও রফিক গ্রেফতার এড়াতে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার কাছে ধরনা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুরানপাড়া গ্রামের মৌলভী নাসির উদ্দিনের দুই ছেলে মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও মৌলভী রফিক উদ্দিন। এক সময় আর্থিক টানাপড়েন থাকলেও আজিজ-রফিকরা এখন বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর। একসময় জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা। তবে ক্ষমতার পালাবদলে রঙ পাল্টে হয়ে যান আওয়ামী লীগের নেতা। এরমধ্যে মৌলভী আজিজ উদ্দিন উখিয়া-টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। বাগিয়ে নেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটি। ক্ষমতাধর এই দুই ভাইয়ের মধ্যে মৌলভী রফিক উদ্দিন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও মৌলভী আজিজ উদ্দিন বাহারছড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান।

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় ইয়া বাপাচার, মানব পাচার ও জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে তাদের দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদকের গডফাদারের তালিকায় মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও মৌলভী রফিক উদ্দিনের নাম রয়েছে শীর্ষে। অথচ, গত দেড় বছর ধরে টেকনাফ ও জেলার বিভিন্ন স্থানে মাদকবিরোধী অভিযান চললেও রহস্যজনক কারণে অক্ষত রয়েছেন দুই ভাই। তবে বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে দুদকের হাতে আটক হন মৌলভী আজিজ উদ্দিন।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, ‘ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে সাড়ে ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে টেকনাফ বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিনকে আটক করা হয়েছে। বাহারছড়া ইউনিয়নের ১২টি প্রকল্পের কোনও কাজ না করে ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে ৩৫ লাখ ৫১ টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।’

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আজিজ উদ্দিন ও রফিক উদ্দিনের বিরুদ্ধে ইয়াবা, মানব পাচার ও জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ সালের ৩০ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকার একটি রোহিঙ্গা বস্তি থেকে জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএস) নেতা, সৌদি আরবের নাগরিকসহ চার জনকে আটক করেছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। ওই সময়ের সরকারদলীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি, তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক উদ্দিন এবং বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিনসহ অনেকে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জঙ্গি তৎপরতা সংক্রান্ত বৈঠক থেকে পালিয়ে যান। পরে আটক সৌদি নাগরিক, মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও মৌলভী রফিক উদ্দিনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে টেকনাফ থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী অভিযানে পালানোর পথ না পেয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১০২ জন মাদক কারবারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও মৌলভী রফিক উদ্দিন। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে এখনও ইয়াবার বড় বড় চালান সাগর পথে আসছে।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম থাকা টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক উদ্দিন। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আমাদের নাম রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এসব বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত লিখিত আপত্তি জানিয়েছি। এটি আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’

মৌলভী রফিক উদ্দিন নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে আরও বলেন, ‘জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার যে মামলাটি করা হয়েছিল, ওই মামলার চার্জশিট থেকে আমাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সকালে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি টিম আমার ভাই বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিনকে কথা বলার জন্য শহরে ঢেকে এনে কোনও কারণ ছাড়াই আটক দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অন্যায়। কারণ, কোনও নোটিশ ইস্যু না করে একজন জনপ্রতিনিধিকে এভাবে আটক করা যায় না। আমরা উচ্চ আদালতে যাবো।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘শুধু মাদক বা সন্ত্রাসীর তালিকা নাম থাকলে হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগেরও প্রয়োজন রয়েছে। তাই সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অপেক্ষায় রয়েছি। যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাবো এবং সঠিক তথ্য প্রমাণ পাবো, অবশ্যই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। যে যত শক্তিশালী হোক না কেন, মাদকের জন্য কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

এই দুই ভাইয়ের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মামলা আদালতে বিচারাধীন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। এছাড়া ঘটনার সময় আমি এখানে দায়িত্বরত ছিলাম না।’