ভরা মৌসুমেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না

টেকনাফে দুশ্চিন্তায় লবণ চাষীরা

জসিম মাহমুদ •

টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ চাষের ভরা মৌসুম এখন। পুরোদমে চলছে মাঠে লবণ উৎপাদন। চাষিরা প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে মাঠে কাজ করছেন। চাষীদের অভিযোগ, লবণ মিলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরী করে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে।

বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, পলিথিন প্রযুক্তির প্রতি একরে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে ৩০ মেট্রিক টন করে। আর সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয় ১০ মেট্রিক টন। লবণ উৎপাদনের জন্য প্রথমে মাঠ পরিষ্কার ও সমতল করতে হয়। তারপর লবণ পানি জমিয়ে রাখার জন্য সেই মাঠে ছোট বাঁধ দিয়ে চার কোনার একাধিক কক্ষ বানাতে হয়। তারপর মাঠে বিছানো হয় কালো পলিথিন। পরে বঙ্গোপসাগর কিংবা নাফ নদীর লোনা পানি ঢুকিয়ে সেই কক্ষ ভর্তি করা হয়।

সূর্যের তাপে কক্ষের পানি শুকিয়ে তৈরি হয় লবণের আস্তর। পরে চাষিরা পলিথিনের ওপর থেকে সেই লবণ সংগ্রহ করে মজুত করেন। কালো পলিথিনে তাপমাত্রা বাড়ে বলে ৯৮ শতাংশ জমিতে কালো পলিথিন বিছানো হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিন লবণ মাঠ ঘুরে দেখা যায়,সাবরাং ইউনিয়নের নয়া পাড়া, শাহপরীর দ্বীপের হাজার হাজার একর জমিতে বিশাল মাঠ জুড়ে লবণের স্তুপ। লবণ শ্রমিকরা তপ্ত রৌদ্রে মাঠে কাজ করছে। কালো পলিথিনে সারি সারি লবণের প্লট বা বেড। ওই বেডের পলিথিনের উপর সাদা লবণের দানা। অনেকেই দেশের সাদা সোনা নামে খ্যাত করেছে এই উৎপাদিত লবণকে। মাঠের শ্রমিকরা ওই বেডে খরা লবণের পানি ছিটাচ্ছেন। শ্রমিকের শরীর থেকে ঝরঝর করে মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। এই তপ্ত রৌদ্রকে তোয়াক্কা না করে পুরোদমে কাজ করছে শ্রমিকরা।

কথা হয় শাহ পরীর দ্বীপের লবণ মাঠের শ্রমিক আব্দুল হামিদের সাথে, তিনি জানান, হঠাৎ করে লবণ এর দাম পড়ে যাওয়ায় খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। এক মণ লবণ বিক্রি করে ৪ কেজি চাল পাওয়া যাচ্ছে না এখন। এভাবেই দিন দিন লবণের দাম কমে গেলে আগামীতে হুমকির মুখে পড়বে লবণ শিল্প।

ইতি মধ্যে সাবরাং ইউনিয়নের শাহ পরীর দ্বীপের জাহেদ উল্লাহর ৪০ হাজার মণ, মোঃ ছিদ্দিক এর ৩০ হাজার মণ, নয়াপাড়ার মোহাম্মদ শরীফ বলির ৭০ হাজার মণ, মো. সালামের ৫০ হাজার মণ, হাফেজ উল্লাহ ২৫ হাজার মণ, মো. সেলিমের ২০ হাজার মণ লবণ উৎপাদন হয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফ উপজেলায় আরও ২ শ শতাধিক চাষিদের উৎপাদিত হাজার হাজার মণ লবণ মাঠের গর্তে পড়ে আছে।

কথা হয় শাহ পরীর দ্বীপের লবণ মাঠের মালিক জাহেদ উল্লাহর সাথে। তিনি জানান, বর্তমানে লবনের দাম প্রতি মণে ২১০-২২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এর দরের মধ্যে উঠানামা করে লবণের দাম। খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করার ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষীদের। চাষীদের অভিযোগ, লবণ মিলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরী করে মাঠ পর্যায়ে লবনের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি উৎপাদিত লবণ কম দামে বিক্রিতে এক প্রকার বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ বাজারে এক কেজি প্যাকেট জাত লবনের ম্ল্যু ৩০-৪০ টাকা।

সাবরাংয়ের লবণ চাষি মোহাম্মদ শরীফ হোসেন বলেন, যেভাবে লবণের দাম দিন দিন কমে যাচ্ছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে লবণ চাষ করে চাষিরা বিনিয়োগও ওঠাতে পারবে না। বলতে গেলে পানির দামেও বিক্রি করা যাচ্ছে না লবণ।

তিনি বলেন, প্রতি একরে লবণ মাঠে খরচ পড়েছে ৫০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে লবণ বিক্রি করে একর প্রতি ২০ হাজার টাকাও পাওয়া যায়নি। চলমান দরে লবণ বিক্রি করা যাচ্ছে না। লবণ বিক্রি করলে এখন বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হবেন চাষিরা। যার ফলে অবিক্রিত লবণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। উৎপাদন যত বেশি হচ্ছে, লবণের দামও তত কমে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা লবণ চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিক মিয়া জানান, ‘বর্তমানে মাঠ জুড়ে বড় বড় গর্তে স্তুপ করে হাজার হাজার মণ উৎপাদিত লবণ মাঠে পড়ে রয়েছে। সিন্ডিকেট করে মধ্যস্বত্বভোগীরা লবণের দাম কমিয়ে দেওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। কিন্তু লবণের ন্যায্যমূল্য নিয়ে কেউ ভাবছেন না। লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি করে দাদনের টাকাও পরিশোধ করতে পারবে না অনেক চাষী।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) টেকনাফের ইনচার্জ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, টেকনাফে লবণ চাষ হচ্ছে ৩ হাজার ৯৪৫ একর জমিতে। ইতিমধ্যে টেকনাফ উপজেলার উপক‚লীয় অঞ্চলে ৫৯ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। তবে গত বছর তুলনায় লবণ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু লবণের দাম কম হওয়ায় চাষিদের মাঝে হতাশ দেখা গেছে। এ বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।