টেকনাফ স্থলবন্দরে ২৬ বছরে রাজস্ব ঘাটতি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা!

গিয়াস উদ্দিন ভুলু,কক্সবাজার জার্নাল •

টেকনাফ স্থল বন্দর (ফাইল ছবি)

মহামারি করোনা ভাইরাস কারনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বানিজ্য টেকনাফ স্থলবন্দরে সরকারী রাজস্বের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখাযায়, বিগত ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর (রবিবার) বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতির পাশপাশি সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধ করাসহ ব্যবসা-বানিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে টেকনাফ-মিয়ানমার মংডু সীমান্ত বাণিজ্য চালু করা হয়।

চলতি বছরের ৫ সেপ্টেম্বর(রবিবার) বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যের বয়স ২৬ বছর অতিক্রম করে ২৭ বছরে পদার্পন করেছে। তবে সীমান্ত বাণিজ্যে মিয়ানমার থেকে শতভাগ পন্য আমদানী হলেও দেশীয় পন্য রপ্তানী হচ্ছে শুধু মাত্র কয়েক ভাগ। তাতে করে গত ছাব্বিশ বছরের আমদানি-রপ্তানিতে ৬ হাজার ৬৫৭ কোটি, ৫৭ লাখ টাকার বিশাল ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

দুদেশের আমদানি-রপ্তানি বিশ্লেষন করে দেখা যায়, বিশাল ঘাটতির মধ্য দিয়ে দু-দেশে বানিজ্যিক পন্য আদান প্রদান রয়েছে। বানিজ্যে মিয়ানমার থেকে শতভাগ পন্য আমদানী হলেও দেশীও পন্য রপ্তানী হচ্ছে নামে মাত্র। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। এই বানিজ্যকে গতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নিলেও রপ্তানী ক্ষেত্রে এর সুফল ভয়ে আনছেনা।

টেকনাফ শুল্ক অফিস সূত্রে জানা যায়,সীমান্ত বানিজ্য গত ছাব্বিশ বছরে ৬ হাজার ৬৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বেশি বানিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ছাব্বিশ বছরে মায়ানমার থেকে ৬ হাজার ৯২৪ কোটি ৬৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫১২ টাকার পন্য আমদানী করা হয়।

অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানী হয়েছে মাত্র ২৬৭ কোটি ৬ লাখ, ৫ হাজার ৪৩৮ টাকা। যার ফলে বানিজ্য ঘাটতি দাড়ায় ৬ হাজার ৬৫৭ কোটি ৫৭ লাখ ৩৪ হাজার ৭৪ টাকা। সীমান্ত বানিজ্যে গত ২৬ বছরে এই পর্যন্ত ১ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।

তবে সম্প্রতি গত কয়েক বছরে করোনার প্রাদুর্ভাব এবং মিয়ানমারের নির্বাচন, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের কারণে উচ্চ শুল্কহারের পণ্য আমদানি কমে গেছে। যে কারণে জাতীয় রাজস্ব বোডের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, মিয়ানমারে রপ্তানী বৃদ্ধি পেলে ব্যবসায় ইতিবাচকসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সহজ হত। এতে রপ্তাণী বাণিজ্যে নিত্য নতুন পণ্য যুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য মিয়ানমারে দেশীয় পন্যের বাজার সৃষ্টিতে বানিজ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে উচ্চ পর্যায়ে রপ্তানী বৃদ্ধির ব্যবস্থা না নিলে বানিজ্য ঘাটতি আরো বৃদ্ধির আশংকা করা হচ্ছে।

তাই সরকারের উচিত মিয়ানমারে রফতানি বৃদ্ধিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করা। এই ছাব্বিশ বছরে মায়ানমারের সাথে ৬ হাজার ৬৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বানিজ্য ঘাটতি।

প্রতিবছর এই ঘাটতির পরিমান বেড়েই চলছে। তবে সীমান্তে বৈধ বানিজ্যের পাশাপাশি মাদক, চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসাকে দায়ী করা হচ্ছে। সীমান্ত বানিজ্য ব্যবসা সম্প্রসারণে দুদেশে জয়েন্ট ওর্য়াকিং গ্রুপের বৈঠক
হলেও রপ্তানী ক্ষেত্রে এর সুফল মিলছেনা।
তবে জয়েন্ট ওর্য়াকিং গ্রুপের বৈঠক আপাতত বন্ধ রয়েছে।

বন্দরের ব্যবসায়ীদের মতে, করোনার কারনে বানিজ্য ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমদানিতে
প্রভাবও পড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে ব্যবসা করতে চাইলেও অবকাঠামো, জেটি, ক্রেন ও শ্রমিক সমস্যার কারণে সুষ্ঠু
বাণিজ্য বাধা গ্রস্ত হচ্ছে।

তাই বন্দরে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই। এদিকে সীমান্ত বানিজ্য চালুর প্রথম দিকে দুদেশের আমদানী-রপ্তানী কাছাকাছি থাকলেও পরবর্তীতে মায়ানমারের পণ্যের আমদানী বেড়ে যায় এবং দেশীয় পণ্যের রপ্তানী কমে যায়। ফলে বানিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকে। পন্য আমদানী করতে বাংলাদেশ থেকে ডলারের যে ব্যাংক ড্রাপ ইস্যু করা হয়, সে তুলনায় মিয়ানমার
থেকে ব্যাংক ড্রাপ আসে খুবই কম। যার ফলে পন্য রপ্তানীতে অসুবিধা সৃষ্টি হয়।

তবে মাদক,চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবস্যাও বন্ধ নেই। বানিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে দেশীয় পন্য রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ জরুরী বলে মনে সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর জানান, সীমান্ত বানিজ্যে দুদেশে নানা সমস্যার মাঝেও পন্য আমদানী-রপ্তানী হচ্ছে। এ বন্দরে অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী মিয়ানমারের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে জড়িত। সীমিত আকারে কয়েকটি পণ্যের
আমদানীর জন্য ৫০ হাজার থেকে ৩০ হাজার ডলারের ব্যাংক ড্রাপ ইস্যু করা যায়।

কিন্তু মুক্ত বাণিজ্যের যুগে এলসির ব্যবস্থা না করলে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে।

তিনি আরো জানান, সীমান্ত বানিজ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ব্যবসায়ীরা দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বানিজ্য ব্যবসায় সমস্যার কারনে অনেক ব্যবসায়ী সটকে পড়ছেন।

‘সম্প্রতি করোনার কারণে আমদানি ও রপ্তানী কমে গেছে। চাহিদা অনুপাতে টেকনাফ বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়া এবং উচ্চ শুল্কহারের পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

টেকনাফ স্থল বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল নুর জানান, সম্প্রতি মিয়ানমারের নির্বাচন, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ ও কভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে সীমান্ত বাণিজ্যে প্রভাব পড়েছে। এ সব কারনে গত কয়েক
অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। নানা সমস্যার কারনে বানিজ্য ব্যবসায় প্রভাব পড়ছে।

তবে ঘাটতি কমিয়ে আনতে মিয়ানমারে দেশীয় পন্যের বাজার সৃষ্টির উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্দর ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে কাস্টমস আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।