দেশে ঠকাচ্ছে দালাল সৌদিতে কফিল

সমকাল ◑

ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের মজুরি দিতে হবে’- যে দেশের আরাফাত ময়দান থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ নির্দেশ দিয়েছিলেন, সে দেশেই তা অকার্যকর। ময়দানের প্রান্তসীমায় নামিরাহ মসজিদের অবস্থান। তার চত্বরে দেখা হয় জনাদশেক বাংলাদেশির সঙ্গে। জানালেন, তারা সবাই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। কেউ চার মাস, কেউ আট মাস ধরে বেতন পান না। বেতন চাইলে নিয়োগকর্তা (কফিল) বলেন, চলে যাও। যাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব এসেছিলেন, তারাও দায়িত্ব নিচ্ছেন না।

সবার হয়ে কথাগুলো জানালেন মো. সুমন। তার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। বছর দেড়েক আগে সৌদি আরব এসেছেন। তিনি বেতন পান না সাত মাস। মক্কা বলদিয়ার (পৌর কর্তৃপক্ষ) অধীনে তাদের চাকরি। কিন্তু তারা বলদিয়ার কর্মী নন। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘রেজা হাইজিনের’ কাছ থেকে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মী সরবরাহ করে বলদিয়া। তারা কর্মীপ্রতি মাসে মাসে টাকা পেলেও, বেতন পান না সুমনরা।

নামিরাহ মসজিদের চত্বরে যাদের সঙ্গে দেখা হলো, তাদের সবাই একই রকম দুর্বিপাকে আছেন বেতন না পেয়ে। মাঝবয়সী এক কর্মী কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেললেন। জানালেন, বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না। দেশে পরিবার অভাবে রয়েছে। বিদেশে তিনি খেয়ে না খেয়ে আছেন। কান্নার তোড়ে নিজের নাম পরিচয়ও বলতে পারলেন না।

সুমন জানালেন, সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরব এসেছেন। দালাল তাকে বলেছিল, ‘ফ্রি ভিসায়’ পাঠানো হচ্ছে। যেখানে ইচ্ছা কাজ করতে পারবেন। কিন্তু সৌদি এসে জানতে পারেন, ‘ফ্রি ভিসা’ বলে কিছুই নেই। তাকে মাসে ৬০০ রিয়াল বেতনে (প্রায় ১৩ হাজার টাকা) পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজে পাঠানো হয়েছে। দেড় বছরে বেতন বাবদ মোটে দেড় লাখ টাকার মতো পেয়েছেন, যা পেয়েছেন তা খাওয়া-দাওয়াতেই শেষ। বিদেশ আসার খরচ তোলা দূরঅস্ত।

মক্কা, মদিনা, জেদ্দায় ১০ দিনে এমন শত সুমনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানালেন, দেশ থেকে আসার সময় ঠকিয়েছে দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সি। সৌদিতে ঠকাচ্ছে কফিল। দেশে দালাল ও এজেন্সিকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে এসেছেন। সৌদিতে আসার পর কফিলকে দিচ্ছেন। সৌদি যেতে সরকার নির্ধারিত ব্যয় এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা। কিন্তু এমন একজনকেও পাওয়া গেল না, যিনি সাড়ে তিন লাখ টাকার কমে এসেছেন। ২০১৫ সালে যারা এসেছিলেন তারা আট লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন।

অর্থনৈতিক মন্দাতে থাকা সৌদি আরব ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ব্যক্তি মালিকের অধীনে কাজ করা বিদেশি কর্মীদের ওপর মাসে ৮০০ রিয়াল কর (রছুম) চাপিয়েছে। যে সব প্রতিষ্ঠানে বেশি সংখ্যায় কর্মী কাজ করেন, সেখানে কর্মীপ্রতি ৪০০ রিয়াল পর্যন্ত দিতে হয়। দেশটির আইন অনুযায়ী বিদেশি কর্মীকে একজন সৌদি নাগরিকের অধীনে থাকতে হয়। ওই নাগরিকই কর্মীর কফিল।

আইন অনুযায়ী কর্মীর রছুম বা কর কফিলের দেওয়ার কথা থাকলেও তা কর্মীকেই দিতে হচ্ছে। যেসব কর্মী বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, তাদের অবশ্য দিতে হয় না। কিন্তু যেসব কর্মী ব্যক্তি-মালিকের কাজে গিয়েছেন তাদের অবস্থা শোচনীয়। তাদের কাঁধে রছুমের সঙ্গে চেপেছে ‘ফয়দা’। কাজের অনুমতি পেতে (আকামা) কফিলকে মাসে মাসে ৫০০ থেকে হাজার রিয়াল পর্যন্ত ‘ফয়দা’ দিতে হয়। না দিলে কফিলের এক অভিযোগে সৌদি ছাড়া হতে হবে।

জেদ্দা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি শেখ আনোয়ার কর্মী হিসেবে সৌদি আরব এসেছেন ২৮ বছর আগে। এখন তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। রয়েছে জনশক্তি ব্যবসায়ও। দেশে রিক্রুটিং এজেন্সি ‘জোনাকি এন্টারপ্রাইজে’ মালিকানা রয়েছে তার। দালাল, এজেন্সি ও শ্রমিকের হাতে শ্রমিকদের শোষিত হওয়ার পুরো বিষয়টি তিনি বোঝালেন।

শেখ আনোয়ারের ভাষ্য অনুযায়ী, ভিসা কেনাবেচা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও দেশের এজেন্সিগুলো কর্মী পাঠান ভিসা কিনে। সৌদিতে কর্মরত কর্মীরাও ভিসা কিনে দেশ থেকে আত্বীয়স্বজনকে আনেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে একজন সৌদি নাগরিককে (কফিল) টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে চাহিদাপত্র নেওয়া হয়। বলা হয়, তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা বাসায় কর্মী প্রয়োজন। এ চাহিদাপত্রে একজন কর্মী প্রথমে ৯০ দিনের ভিসায় সৌদি যান। কফিলের অধীনে তিনি আকামা পান, যা প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। প্রায় প্রতিটি চাহিদাপত্রই কেনাবেচা হয়। একসময় তা সাত থেকে ১৫ হাজার রিয়ালে (দেড় থেকে তিন লাখ টাকা) কেনাবেচা হতো। এখন তা বাংলাদেশি টাকায় এক থেকে সোয়া লাখ টাকায় কেনাবেচা হয়। চাকরি দেওয়ার নামে কফিল শুরুতেই এ টাকা ঘুষ বাবদ নেয়।

এর সঙ্গে যোগ হয় ভিসা প্রসেসিং ফি, মেডিকেল ফি, বিমান ভাড়া, কর্মীর ছাড়পত্রের জন্য মন্ত্রণালয়ে ঘুষ, গ্রাম থেকে কর্মী আনা দালালের কমিশন ছাড়াও ঘাটে ঘাটে বৈধ-অবৈধ নানা ব্যয়। সব মিলিয়ে অঙ্কটি দাঁড়ায় আড়াই থেকে পৌনে তিন লাখ টাকা। এজেন্সির মুনাফাসহ কর্মীর কাছ থেকে নেওয়া হয় সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা। সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা কর্মীর কাছ থেকে বাড়তি নেয় দালাল ও এজেন্সিগুলো।

এত টাকা খরচ করে কর্মী সৌদি আরব গিয়ে জানতে পারেন, যে কফিলের চাহিদাপত্রে তিনি এসেছেন, আদতে তার কর্মীর প্রয়োজন নেই। যে চাকরির কথা বলে তাকে আনা হয়েছে, সেটির কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই কফিলের কাছ থেকে বেতন পাওয়ার সুযোগও নেই। কাজ জুটিয়ে নিতে হয় নিজেকেই। কফিলের চাকরি দেওয়ার সক্ষমতা আছে কিনা, তা যাচাই করে বাংলাদেশ দূতাবাসের চাহিদাপত্র সত্যায়ন করা কথা থাকলেও আদতে তা ঠিকভাবে হয় না।

‘শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসন :সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছিল, শুধু ২০১৬ সালে ভিসা কেনা বাবদ পাঁচ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি কর্মীরা বিদেশ যেতে যে টাকা ব্যয় করেন, তার ৬৭ শতাংশই যায় দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সির পকেটে।

সৌদিতে গিয়ে ভিসায় নির্ধারিত কাজ না পেয়ে শুরুতেই অবৈধ কর্মী হয়ে গেলেও, আকামা বৈধ রাখতে প্রতি মাসে কফিলকে টাকা দিতে হয়। কারণ চাইলেই আকামা বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে তার। আবার আকামাতে নির্ধারিত এলাকায় না থাকলে, কাজ না করলে সৌদি পুলিশ কর্মীদের ধরে দেশে ফেরত পাঠায়। গত বছর এমন ২১ হাজার কর্মী ফেরত এসেছেন।

সৌদিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বললেন, তিনি বিষয়টি খুব শক্তভাবে তুলেছিলেন সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু পুলিশ ছবি-ভিডিওসহ প্রমাণ দিয়েছে, বাংলাদেশি কর্মীরা আকামাতে নির্ধারিত কাজ না করে রাস্তায় হকারি, ভিক্ষা বা দোকানে কাজ করছে। এরপর দূতাবাসের আর কিছু করার থাকে না। বেতন বকেয়া থাকলে তা উদ্ধারে দূতাবাস মধ্যস্থতা করছে। তবে ‘ফয়দা’র বিষয়টি অনানুষ্ঠানিকভাবে হয় বলে দূতাবাসে কিছু করার থাকে না বলে জানান গোলাম মসিহ।

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর ইরফান আহমদ মদিনায় কাপড়ের দোকান চালান। ২০১৫ সালে ছয় লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আসেন। আসার পর বুঝতে পারেন, দালাল-রিক্রুটিং এজেন্সি ঠকিয়েছে। মালির কাজের কথা বলে পাঠালেও সে পদের কাজ নেই।

ইরফানের দোকানে সবচেয়ে বড় ও সুন্দর চেয়ারটি সব সময় ফাঁকা থাকে। দোকানে পুলিশ এলে, ফাঁকা চেয়ার দেখিয়ে বলেন কফিল বাইরে রয়েছেন। তিনি জানালেন, দোকানের আসল মালিক বাংলাদেশি। কিন্তু কাগজেকলমে মালিক সৌদি নাগরিক। কারণ, বিদেশি কারও সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ নেই সেখানে। বাংলাদেশি যিনি ব্যবসায় করেন, এমন কোনো কফিলের নামে করেন। পুলিশ প্রমাণ চাইলে, ফোন করে কফিলকে আনা হয়। এজন্য তাকে মাসে মাসে ‘ফয়দা’ দিতে হয়। (শেষ)