কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অনেক অভিযোগ করলেন কক্সবাজার আ.লীগের নেতারা

বিশেষ প্রতিবেদক •

সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন–বাণিজ্য, অযোগ্য ব্যক্তিকে টাকার বিনিময়ে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা, নৌকার ভরাডুবি, সাংসদদের সঙ্গে দলীয় নেতাদের দূরত্ব-কোন্দল ও দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করানো, জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে আঁতাত এবং দলের ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করা-এমন অনেক অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের জানাল কক্সবাজার তৃণমূল আওয়ামী লীগ।

আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের বিরোধ মীমাংসায় এই স্তরে প্রতিনিধি সভার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারে চলছে তৃণমূল প্রতিনিধি সভা। সৈকতের পর্যটন মোটেল উপলের মাঠে জারা কনভেনশন সেন্টারে আজ বুধবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় এই সভা। এতে যোগ দিয়েছেন ৯টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভার অন্তত তিন হাজার নেতা-কর্মী।

এই সভায় প্রধান হিসেবে উপস্থিত আছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। বিশেষ অতিথি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ। সভাপতিত্ব করছেন জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী।

সকাল ১০টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সভা। বেলা দুইটায় মধ্যাহ্ন বিরতির আগপর্যন্ত ডজনখানেক নেতা তাঁদের বক্তব্যে কক্সবাজার তৃণমূল আওয়ামী লীগের নানা সমস্যা তুলে ধরেছেন।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনকে নতুনভাবে গোছানোর জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিনিধি সভা করার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের প্রাণ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নিয়ে এই আয়োজন। আশা করা যাচ্ছে এই সভার মাধ্যমে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ আরও সুসংগঠিত, শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ হবে।

নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে শুভেচ্ছা বক্তব্যে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করে। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মনের কথা শুনতে এই সভার আয়োজন করা হয়েছে। এরপর দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান।

বক্তব্য দেন টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও এবার দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হওয়া আজিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পক্ষে কেউ কাজ করেননি। টাকার জন্য নেতা-কর্মীরা দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন এবং ভোট কারচুপির মাধ্যমে নৌকার ভরাডুবি ঘটানো হয়েছে।

টেকনাফের সবরাং ইউপির নৌকা প্রতীকের পরাজিত প্রার্থী ও শাহ পরীর দ্বীপ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সোনা আলী বলেন, দলের নেতারা নৌকাকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি প্রকাশ্যে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছিলেন। বদির কারণে টেকনাফের ছয়টি ইউনিয়নের চারটিতে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে। বদির নিজের ইউনিয়নে বিএনপির একজন কর্মী ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নে জামায়াতের আমিরও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের জয়ের নেপথ্যে কার ইন্ধন ছিল তা সবার জানা।

সোনা আলী আরও বলেন, এসব দেখে ভোটের মাঠে তাঁর স্ত্রী স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এখনো আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মামলা-হামলা করে হয়রানি করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। একপর্যায়ে সোনা আলী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারপর বলেন, সাবেক এমপি বদি নির্বাচনী জনসভায় নৌকার বিরুদ্ধে কী কী বলেন এসব ভিডিও তাঁর হাতে আছে, অনুমতি পেলে এখানে বাজিয়ে শোনাতে চান। তখন মাহবুবুল আলম হানিফ সোনা আলীকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, সেই ভিডিও তাঁর কাছে পাঠাতে।

পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি খায়রুল এনাম বলেন, মনোনয়ন বাণিজ্য সব জায়গায়। তাঁকে দলের প্রার্থী না করে অযোগ্য একজন নেতাকে নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনে নৌকায় ভোট পড়েছিল মাত্র ১৪৭টি। এ লজ্জা তৃণমুলের নেতারা এখনো মুছতে পারছে না। এখানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি এক নেতা। চকরিয়ার দুটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ১০০ ভোটও পাননি। একারণও মানুষ জানে। অথচ কোন প্রতিকার নাই। তৃণমুল নেতাদের কথা কেউ শোনে না।

রামুর ঈদগাড় ইউনিয়ন আ. লীগের সাধারণ সম্পাদক কায়েসুল ইসলাম বাঙালি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধার সন্তান। কিন্তু ইউনিয়নে রোহিঙ্গাদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ দেশের নাগরিক হয়েও জন্মনিবন্ধন সনদ মিলছে না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ত্রাণ ও ভিজিএফের চাল দেওয়া হয় না। আমরা আওয়ামী লীগ করে কী লাভ।

বেলা দুইটা পযন্ত তৃণমুলের অন্তত ১২ জন নেতা বক্তব্য দেন। কয়েকজন নেতা রামু, চকরিয়া, পেকুয়া মনোনয়ন বাণিজ্য, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে সাংসদের বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করানো এবং উখিয়া ও টেকনাফে দলীয় সাংসদদের জামায়াত বিএনপির প্রার্থীর সাথে আঁতাতের অভিযোগ তুলেন।

কয়েকজন নেতা বলেন, দলের বিদ্রোহী প্রার্থী যাঁরা ছিলেন তাঁদের তখন সাময়িকভাবে দল থেকে বহিস্কার করা হলেও এখন অনেকে এই সভাতে এসে হাজির। এটাও লজ্জার ব্যাপার। তখন সভাস্থল থেকে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাঁদের পক্ষে কাজ করা দলের নেতাকর্মীদের সভাস্থল ত্যাগ করার ঘোষণা দেন দলের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ।

বিকেল তিনটার দিকে পুনরায় সভা শুরু হয়েছে। সবশেষে তৃণমুল নেতাদের বক্তব্যের জবাব এবং আগামীতে করণীয় বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা মাহবুবুল আলম হানিফের।

সভায় উপস্থিত আছেন, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এস,এম কামাল হোসেন, ধর্ম-বিষয়ক সম্পাদক সিরাজুল মোস্তফা, অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খান, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, কক্সবাজার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, কক্সবাজারের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল, জাফর আলম, আশেক উল্লাহ রফিক, শাহিন আক্তার, কানিজ ফাতেমা আহমেদ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ প্রমুখ।