পূর্ণিমা রাতে স্ত্রীদের হত্যা করতেন তিনি!

দিদারুল আলম •


ক্লু-লেস মার্ডার। সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার চার মাস পর মিলেছে প্রত্যক্ষদর্শী। সেই প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দিতে উঠে এলো সাথী বানু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার স্বামী আকরাম হোসেনের জড়িত থাকার বিষয়টি। সাক্ষীর জবানবন্দিই নয়, আসামির দেওয়া তথ্যমতে ঘটনাস্থলের পাশের পুকুর থেকে উদ্ধার করা হলো লোহার হাতুড়ি। যে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করে স্ত্রীকে হত্যা করেন স্বামী।

 

এর আগে আসামি আকরামের দুই স্ত্রীর মৃত্যুও হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। নিহতদের পরিবার মামলা না করায় তিনি পার পেয়ে যান। তবে তৃতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর সড়ক দুর্ঘটনা বা ছিনতাইয়ের নাটক সাজিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা চলেছিল। কিন্তু ভিকটিমের ভাই একজন আইনজীবী হওয়ায় একের পর এক স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা তার মনে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে। সেখান থেকে করা হয় মামলা। সেই মামলার তদন্তে নেমেই পুলিশ এই সিরিয়াল কিলারে সন্ধান পায়।

পুলিশের তদন্তের অগ্রগতি বলছে, সাথী বানুর নামে মেটলাইফে দুটি জীবন বিমা করেছিলেন আকরাম। যার নমিনি ছিলেন তিনি। দুর্ঘটনায় স্ত্রীর মৃত্যুর বিষয়টি চালিয়ে দেওয়া গেলে জীবন বিমার দুটি পলিসি থেকে তিনি প্রায় ১ কোটি টাকা পেতেন। আর এই অর্থ পাওয়ার আশায় তিনি স্ত্রীকে হত্যা করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নওগাঁ সদর মডেল থানার এস আই মো. আব্দুল বারেক ইত্তেফাককে বলেন, তদন্তে নেমে দেখতে পেয়েছি দুই বছরের মধ্যে আকরামের তিন জন স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে রবিবার চাঁদনি রাতে। এটা আমাদের কাছে খুবই আশ্চর্যজনক লেগেছে। আসামি অত্যন্ত চতুর প্রকৃতির। কিন্তু এক জন প্রত্যক্ষদর্শী পেয়ে যাওয়ায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার জড়িত থাকার সব তথ্য-প্রমাণ আমরা পাই। তিনি বলেন, এখন ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। সেটা পেলেই তদন্তের বাকি কাজ শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে।

দুই বছরে তিন স্ত্রীর মৃত্যু :
নওগার বালিয়াগাড়ী বাসিন্দা মো. আকরাম হোসেন (৫১) ১৯৯৭ সালে বিয়ে করেন লাভলী সুলতানাকে। সেই ঘরে দুটি সন্তান রয়েছে। ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাত ১১টায় মারা যান তার প্রথম স্ত্রী। ২০২০ সালের ২৪ জানুয়ারি রাবেয়া খাতুন নামে এক নারীকে বিয়ে করেন তিনি। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা এই স্ত্রী ২০২১ সালের ২৩ মে রাত ১২টায় মারা যান। দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর ঐ বছরের ৯ জুলাই বগুড়ার আদমদীঘির সান্তাহার যোগীপুকুর গ্রামের সহিদুল হকের কন্যা সাথী বানুকে (৩৫) বিয়ে করেন। বিয়ের পর তৃতীয় স্ত্রীকে নমিনি করে তিনটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা ঋণ নেন। এই ঋণের টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। এছাড়া মেটলাইফ নওগাঁ ব্রাঞ্চ থেকে সাথী বানুর নামে ১২ বছর মেয়াদি দুটি জীবন বিমা পলিসিও করেন। প্রতিটি পলিসির মাসিক কিস্তি ছিল ১৫ হাজার টাকা। দুটি কিস্তিও দিয়েছেন।

এরই মধ্যে গত ১৬ জানুয়ারি রাতে শ্বশুড়বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে মোটরসাইকেলে ফেরার পথে নওগাঁর দুবলাহাটি ইউনিয়নের যমুনী মধ্যপাড়া গ্রামের সড়কে রাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাথী বানু। পরদিন সাথীর পিতা নওগাঁ সদর থানায় মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। চার মাস পর সোহেল নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী খুঁজে পান তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল বারেক। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে আসে স্ত্রী হত্যায় আকরামের জড়িত থাকার তথ্য। গ্রেফতারের পর থেকে আছেন কারাগারে। এখন হাইকোর্টে জামিন চেয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের সিরিয়াল কিলারের কাহিনি গোয়েন্দা উপন্যাসে পড়েছি। কিন্তু আজ বাস্তবে দেখতে পেলাম। এই সিরিয়াল কিলার যাতে উচ্চ আদালত থেকে জামিন না পান সেজন্য আমরা জামিনের বিরোধিতা করব। সাথী বানুর ভাই অ্যাডভোকেট আমিনুল হক বলেন, পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি আমার বোনের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মানিনি। যদি নিতাম তাহলে আমার বোনও অন্য দুজন নারীর মতো বিচার পেত না।

বল তুমি কিছু দেখনি’ : প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সোহেল হোসেন বলেন, “আমি এনামুলের গ্যারেজে অটোটমটম গাড়ি রেখে রাতে শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছিলাম যমুনির ভেতর দিয়ে। দেখি মোটরসাইকেলের পেছনের লাল আলো জ্বলে আছে। আমি সেখানে সাইকেল দাঁড় করিয়ে ছেলে মানুষটিকে টেনে তুলি। এর সঙ্গে একটি মেয়ে মানুষ দেখি গাছের চিপায় পড়ে আছে। ছেলে মানুষটি হেলমেট খুললে আমি তাকে চিনতে পারি। তার নাম আকরাম। আমি কীভাবে কী হলো জানতে চাইলে আকরাম মামা কোনো উত্তর দেয় না। আমি মামিকে ধরে ওপরে তুলে নিতে বললে, সে আমাকে ধরে ঝটকা মেরে ফেলে দেয়। আকরাম মামা তখন আমাকে লাইট অফ করতে বলে। মোটরসাইকেলের ওপরে হাতুড়ি আছে কি না, দেখতে বলে। আমি বলি হাতুড়ি কী করবেন, তখন আমি চলে আসতে চাইলে সে আমার হাত চেপে ধরে আমাকে বলে, ‘বল তুমি কিছু দেখনি’। আমি তখন মামার কথায় সম্মতি দিয়ে সেখান থেকে চলে আসি। পরে শুনি আকরাম মামার স্ত্রী মারা গেছেন।”

এদিকে জিজ্ঞাসাবাদে আসামির দেওয়া তথ্যমতে গত জুলাই মাসে ঘটনাস্থল থেকে ২৫ গজ দূরে পুকুরের মধ্যে থেকে ১২ ইঞ্চি লম্বা একটি লোহার হাতুরি উদ্ধার করা হয়।

আদালতের নির্দেশে তথ্য দিল মেট লাইফ :
আদালতের নির্দেশে সাথী বানুর জীবন বিমার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে মেটলাইফ। প্রতিবেদনে মেটলাইফ বলেছে, সাথী বানু ১২ বছর মেয়াদি ডিপিএস সিলভার পলিসি গ্রহণ করেছিলেন। উক্ত পলিসিতে বিমাকৃত ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যুজনিত কাভারেজ ২১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া বিমাগ্রাহকের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কাভারেজ ছিল ৪৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া সাথী বানু ১৩ বছর মেয়াদি আরো একটি ডিপিএস সিলভার পলিসি গ্রহণ করেন। ঐ পলিসিতে স্বাভাবিক মৃত্যুজনিত কাভারেজ ছিল ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কাভারেজ ছিল ৪৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। দুটি পলিসির নমিনি ছিলেন আকরাম।