‘রোহিঙ্গা নয়’ প্রত্যয়নপত্র রোহিঙ্গাদের হাতে

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামা-আলীকদম •


এলাকায় চিহ্নিত রোহিঙ্গা মো. ফরিদ আলম। বর্তমানে লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের বাঁশখাইল্যা পাড়ায় বসবাস করেন। গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

মিয়ানমারের এই নাগরিক ৭/৮ বছর আগে লামায় এসে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড কুমারী বাজার এলাকার মির আহামদের মেয়ে ফাতেমা আক্তারকে বিবাহ করেন। দুই বছর আগে তাদের তালাক হয়ে যায়। তালাকের আগেই সে ভোটার হওয়ার জন্য শ্বশুর বাড়ির সকলের আইডি কার্ড ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে রাখেন।

এদিকে সারাদেশের ন্যায় গত ২৫ জুন থেকে লামা উপজেলায় ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু হয়। এই সুযোগে রোহিঙ্গা নাগরিক মো. ফরিদ আলম শ্বশুর মির আহামদকে বাবা, শাশুড়ি জমিলা বেগমকে মা, শ্যালক আব্দুর রহিম, রশিদ আহমদকে বড় ভাই এবং শালিকা মাহমুদা আক্তারকে বড় বোন বানিয়ে উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ইয়াংছা নতুন পাড়ার ঠিকানায় ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। এর সাথে ভোটার হতে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন, হালনাগাদ চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, রোহিঙ্গা নয় সনদ, নিজের চাচা ফুফু থাকা সত্ত্বেও নাই মর্মে প্রত্যায়ন, বিলম্ব ভোটার হওয়ার প্রত্যায়নপত্র, ভূমিহীন সনদ, হোল্ডিং করের রশিদসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংযুক্ত করে আবেদন করেন। প্রতিটি কাগজ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান দ্বারা সত্যায়িত করেছেন।

ইতিমধ্যে তার আবেদনের কপি তথ্য সংগ্রহকারী কর্তৃক পূরণ করে সুপারভাইজার নিকট জমা হয়েছে।

ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ওয়ার্ড ৭, ৮, ৯, ৪ ও ১ এর অংশের দায়িত্বরত সুপারভাইজার মো. নাজেম উদ্দিন সন্দেহবশত কয়েকটি ফরম সরেজমিনে তদন্তে গেলে বিষয়টি বেরিয়ে আসে। আবেদনে ফরিদ আলম বাবার নাম মির আহামদ লিখলেও সরেজমিনে গিয়ে এলাকার সবার সাথে কথা বলে জানা যায় তার বাবার নাম নূর ইসলাম। তারা রোহিঙ্গা নাগরিক।

নাজেম উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা সন্দেহে যাচাই-বাচাইয়ের জন্য ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ২০টি, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ১০টি ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আটটি আবেদন তথ্য আমি সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে নিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকগুলো রোহিঙ্গা নাগরিক বলে নিশ্চিত হয়েছি।

ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের তথ্য সংগ্রহকারী মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এলাকায় রোহিঙ্গা হিসাবে চিনে এইরকম তিনটি পরিবারের আটজন ভোটার হওয়ার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছে। রোহিঙ্গারা সকল কাগজপত্র কিভাবে যোগাড় করল? বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত।

একইভাবে ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের শামুকছড়া মুখ গ্রামের মো. মফিজ, পিতা- মোস্তাহিন, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বনপুর গ্রামের সফিক আহামদ মেয়ে খালেদা বেগম, জয়নাল উদ্দিনের মেয়ে কহিনুর আক্তার, আবু তালেবের মেয়ে ফাতেমা বেগম, বাঁশখাইল্যা ঝিরির আব্দুর রশিদের ছেলে মোহাম্মদ সৈয়দ নুর, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের রাঙ্গাঝিরি গ্রামের মহিউদ্দিনের স্ত্রী হামিদা বেগম, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের হায়দারনাশী গ্রামের মৃত হায়দার আলীর ছেলে আব্দুল আজিজসহ শত শত রোহিঙ্গা নাগরিকের ভুয়া আবেদন জমা পড়েছে।

অনেক তথ্য সংগ্রহকারী বলেন, আমরা এইসব আবেদন না নিতে চাইলে আমাদের ফোনে হুমকি দেয়া হয়। রোহিঙ্গারা কৌশলে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ভোটার হওয়ার চিত্র উপজেলার একটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নে লক্ষ্য করা যায়। তবে কম আর বেশি।

ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ১ নম্বর ওয়ার্ডের গয়ালমারা (একাংশ), সাপেরঘারা, ২ নম্বর ওয়ার্ডের হারগাজা, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাঁশখাইল্যা ঝিরি, বনপুর বাজার পূর্ব পাশ, নতুন পাড়া, ৫ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু কিছু স্থান রোহিঙ্গাদের হটস্পট। আগে যেসব রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে এখন তাদের পরিবারের লোকজন ভোটার হচ্ছে। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করেছে।

ইয়াংছা বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তানরা এখন সাংবাদিক, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতা।

ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল হোসাইন চৌধুরী বলেন, আজ ১৫ জুলাই ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ২৬টি ভুয়া আবেদনের কাগজপত্র বাতিল করেছি। গণশুনানি করে ভোটার যাচাইবাচাই করা হবে।

কিভাবে রোহিঙ্গারা অনলাইন জন্ম নিবন্ধন, হালনাগাদ চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, রোহিঙ্গা নয় সনদ, নিজের চাচা ফুফু থাকা সত্ত্বেও নাই মর্মে প্রত্যায়ন, বিলম্ব ভোটার হওয়ার প্রত্যায়ন পত্র, ভূমিহীন সনদ, হোল্ডিং করের রশিদ পেয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি সবাইকে চিনি না। মেম্বাররা সুপারিশ করেছে আমি সনদ দিয়েছি। খালি ফরমে স্বাক্ষর ও সীল দেয়ার বিষয়ে বলেন, কাজ দ্রুত ও সহজ করতে যাদের চিনি তাদের খালি ফরমে স্বাক্ষর করা হয়েছে।

লামার ইউএনও মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, সরকার চায় না কোনভাবে ভিন্ন দেশের মানুষ ভোটার হোক। বিষয়টি জেনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, মেম্বার, তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজারদের একাধিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এরপরেও এইরকম অসংগতি মেনে নেয়া যায় না।