প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মাদ্রাসার ছাত্রীকে অপহরণের চেষ্টা,ফাঁকা গুলি,মাকে কুপিয়ে জখম

মোহাম্মদ আবু তাহের, মহেশখালী (কক্সবাজার)

মহেশখালীতে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কুতুবজোমের এক মাদ্রাসার ছাত্রীকে অপহরণের চেষ্টা চালানোর সময় মা বাধা দিলে তাকে কুপিয়ে জখম করেছে অপহরণকারীরা।

রবিবার (৩ ফেব্রুয়ারি ) রাত ২.৩০ ঘটিকার সময় মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউপিস্থ ঘটিভাঙ্গা এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার বিচার দাবী করে মা বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় একটি লিখিত এজাহার জমা দিয়েছেন। মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি)প্রভাষ চন্দ্র ধর এর নির্দেশে তাৎক্ষনিক এস আই পংকজ এর নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

ঘটনাটি ধামচাপা দিতে ছাত্রীর পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে অপহরণকারীরা। হুমকিতে বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতায় ছাত্রীর পরিবার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত রবিবার (৩ ফেব্রুয়ারি ) রাত অনুমান ২.৩০ ঘটিকার সময় বাড়ির দরজা ভেঙ্গে বাড়িতে প্রবেশ করে অপহরণের চেষ্টা চালায় সাগর, তারেক, জাকিরের নেতৃত্বে একদল মুখোশ ধারী ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী।

অপহরণের চেষ্টার সময় ওই ছাত্রী মা বাধা দিলে তাকে কুপিয়ে জখম করে, ছাত্রীর চিৎকার করলে আশেপাশে থাকা প্রতিবেশিরা ছুটে আসেন।

এ সময় অপহরণকারী সাগর,তারেক,জাকির,সহ ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা সঙ্গীরা গুলি ছুড়ে এলাকায় জনসাধারণের মনে আতংকের সৃষ্টি করে পালিয়ে যায়।

আদর মণি বয়স ১৫ বছর। মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের তাজিয়াকাটা সুমাইয়া (রা.)বালিকা দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির নিয়মিত ছাত্রী।

আদর মণির পিতা মকছুদ আলম পেশায় একজন রংমিস্ত্রী। মা ছলিমা খাতুন গৃহিনী। বেশ কিছু দিন ধরে আদর মণিকে মাদ্রাসায় যাবার পথে স্থানীয় মোঃ সাগর বখাটে ছেলে মোঃতারেক, মোঃ জাকির বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। ছয় মাস আগে মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে আদর মণিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আদর মণি কে সাগর শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং অপহরণের হুমকি দেয়।

আদর মণি বিষয়টি তার পিতা-মাতাকে জানায়। বাবা-মা বিষয়টি জানার পর মেয়ের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মাদ্রাসার হোস্টেলে রেখে পড়া লেখা চালাচ্ছিল। ঘটনার দিন আদর মণি নিজ বাড়িতে আসে।

বখাটের উপদ্রব বৃদ্ধি….

বর্তমানে সারা দেশে বখাটের উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় আদর মণির মতো অনেক মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকগণ তাদের কন্যা-সন্তানদের স্কুল,মাদ্রাসায় পাঠাতে গিয়ে আতঙ্কবোধ করছেন।স্কুল,মাদ্রাসা গামী ছাত্রীরা বিশেষকরে গ্রামাঞ্চলে বা একটু দুর্গম এলাকায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়ার পথে অত্যন্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বখাটেদের রোষানলে পড়ে প্রতিনিয়ত নানা ধরণের প্রতিকুলতার সম্মুখীন হচ্ছে মেয়েরা। বখাটেদের উৎপাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা ছাড়াও এ ধরনের ঘটনা কমবেশি সারাদেশেই ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রীরা বখাটেদের ফাঁদে পড়ে প্রতারণা ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।

এসব ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাপা পড়ে যায়। কারণ অভিভাবকগণ মান-সম্মানের কথা ভেবে এবং সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তা করে ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে চান না। কন্যা সন্তানকে স্কুল,মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেন এমনকি অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন। এতে করে আমাদের দেশে নারী শিক্ষা সম্প্রসারণে যেমন বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি বাল্য বিবাহ ও বহুবিবাহের ঘটনাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মেয়েরা প্রতিদিনই যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ ও হত্যাসহ নানা ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছে। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, উত্যক্ত করার ক্ষেত্রে শুধু বখাটেরাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক বা নিকট আত্মীয় অনেকাংশে দায়ী। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিদিন গড়ে চারজন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এই সভ্য সমাজেও নারীদেরকে ভোগের সামগ্রী মনে করার বিকৃত মানসিকার জন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ। নারীদের যে আপন ঠিকানা তার ঘর সেখানেও কিন্তু নারীরা অনেক সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বখাটেদের অত্যাচার ও যৌন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অকালে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য নারী ও শিশুর জীবন। আমরা পত্র পত্রিকার মাধ্যমে যে ঘটনাগুলো জানতে পারি বাস্তবে তার থেকেও হয়তো আরো বেশি হবে। এই ধরনের নির্যাতনের ভয়াবহতা ও যন্ত্রণার ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব নয়। কারন এর ফলে অনেকেই মানসিক ও শারীরিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। কেউ কেউ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আবার কেউবা শেষ পরিণতি হিসেবে মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছে। অথচ সঠিক সময়ে নির্যাতিত নারীদের উপর্যুক্ত চিকিৎসা ও আইনগত সহায়তা প্রদান করা গেলে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

নারীর উপর নির্যাতনের দায় কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ সবার উপরই বর্তায়। রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা। বাড়ি ফেরার সময়, স্কুল যাত্রাপথে কিংবা পরিবহনে যখন নারীরা ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ঘটে তখন আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতাই প্রমান করে। দেশের অর্ধের জনগোষ্ঠী নারী। তারা যদি রাস্তায় বেরুবার সময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকে তাহলে তাদের সামগ্রিক কর্মকা- যে বাধাগ্রস্ত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই নারীর নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার।

দেশে যৌন হয়রানির যে ঘটনা ঘটছে তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। নারী নির্যাতন বা লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিয়মিতই সভা, সেমিনার, মিটিং, মিছিল, টকশো হচ্ছে। কিন্তু কতটা কার্যকর হচ্ছে সেগুলো? গোড়ার দিকের কথা চিন্তা করতে হবে আমাদের। তা হলো আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না করলে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। যেমন-একজন পুরুষকে শিখতে হবে একজন নারীকে যৌন হয়রানি করা কতটা অনৈতিক ও অবমাননাকর বা একজন নারীকে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তার শরীরে হাত দেওয়া কতটা অন্যায়? এজন্য দরকার ঐ ব্যক্তির বেড়ে ওঠার পরিবেশে পরিবর্তন। প্রয়োজন পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সত্যিকার নৈতিক শিক্ষা দেওয়া।

বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ছোট শিশুরাও ইন্টারনেট ও ফেসবুকে আসক্ত। আবার অনেক বাবা-মা ব্যস্ততার অজুহাতে তার সন্তানকে সময় দিতে পারেন না বা তারা কী করছে সে খোঁজ খবরও রাখেন না। ফলে বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় না। এতে শিশুরা পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। অভিভাবকে তার সন্তানকে আগে শিখাতে হবে নারীরা সমাজের অংশ। দেশের উন্নতিতে তারাও সমান অংশীদার। তাদেরকে সম্মান করতে হবে, তাদেরকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

জাতিসংঘের সমীক্ষা মতে, বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আইন প্রনয়ন করা হয়েছে। আমাদের দেশেও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক আইন রয়েছে। দ্রুত আইনে তাদের বিচার করা হচ্ছে, তাৎক্ষণিকভাবে জেল জরিমানাও হচ্ছে। তারপর নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমাদের কন্যাশিশুরা যদি পিছিয়ে পড়ে, তারা যদি তাদের চলার স্বাধীনতা হারায়, তারা যদি বন্দী হয়ে ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তাদের শিক্ষা গ্রহণ যেমন বাধাগ্রস্ত হবে, তেমনি বাধাগ্রস্ত হবে দেশের জাতীয় উন্নয়ন। বেগম রোকেয়ার নারী মুক্তির স্বপ্নও শিক্ষা বিস্তারের এই যুগে পদদলিত হবে। তাই আমাদের এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা হবে আমাদের কন্যাশিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল। সে সমাজে আমাদের পুত্র কন্যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অপরের সহযোগী হয়ে কাজ করতে পারবে। সেখানে নারীরা আত্মহননে প্ররোচিত হবে না কিংবা আমাদের পুত্র সন্তানরা যৌন হয়রানির কলঙ্কে কলঙ্কিত হবে না। তাই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

বর্তমানে আদর মণির পরিবার অপহরণ কারীদের হুমকি মুখে সরম নিরাপর্তা হিনতায় ভোগছে, মেয়ের লেখা পড়া চালিয়ে যেতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সহ সকলের সহযোগি চান আদর মণির পিতা মাতা।