বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতি’ নিরূপণে কাজ শুরু হয়নি এক বছরেও!

অনলাইন ডেস্ক •

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে বনভুমি, বনজ সম্পদ, জীববৈচিত্র ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে গঠিত ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’র কর্মকান্ড এক বছরেও শুরু হয়নি। কমিটি গঠনের পর এখনও কোন অর্থ বরাদ্দ না আসায় বিশেষজ্ঞরা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ শুরু করতে পারছেন না বলে জানিয়েছে বনবিভাগ।

গত বছরের ৫ নভেম্বর বনবিভাগের পক্ষ থেকে এই বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইনকে প্রধান করে গঠিত এই ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’তে আরো রয়েছেন একই বিভাগের প্রফেসর ও বনসম্পদ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. মো. দানেশ মিয়া, ঢাকাস্থ ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. একেএম এনামুল হক। কমিটিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক আবদুল আউয়াল সরকার ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) চট্টগ্রামের প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) এর প্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসনের একজন করে প্রতিনিধিকে রাখা হয়েছে।
এর আগে একই বছরের ১৮ অক্টোবর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় সংসদে’র ‘বন ও পরিবেশ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি’র বৈঠকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে ধ্বংস হওয়া বনজ সম্পদ এবং জীববৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৪২০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে জীববৈচিত্রের ক্ষতি ১৮২৯ কোটি টাকা এবং বনজ দ্রব্যের ক্ষতি ৫৯১ কোটি টাকা বলে ধরা হয়। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে নতুন পুরনো মিলে ৩৪ টি শরণার্থী শিবিরে সরকারের হিসাব অনুযায়ী ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।

বনবিভাগের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের কারণে ৮ হাজার একর বন ধ্বংস হয়েছে। এরমধ্যে বসতি নির্মাণ করা হয়েছে ৬ হাজার ১৬৪ একরের উপর। আর রোহিঙ্গাদের জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের ফলে ধ্বংস হয়েছে আরো ১ হাজার ৮৩৭ একর বনভুমি। সেখানে শত বছরের প্রাকৃতিক বন ছিল ৪ হাজার ১৩৬ একর এবং সামাজিক বন ছিল ২ হাজার ২৭ একর।
আর তথ্য প্রকাশের পরই এই পরিসংখ্যান নিয়ে দেশের পরিবেশ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা প্রতিবেদনটিকে সম্পূর্ণ ‘অনুমান’ নির্ভর একটি ‘ভুল’ প্রতিবেদন বলে আখ্যায়িত করেন এবং এই ধরনের প্রতিবেদনের কারণে পরিবেশ পুনরুদ্ধারে তহবিল সংগ্রহে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহলে সমস্যায় পড়তে হবে বলেও আশংকা করেন। পরে সমালোচনার মুখে ওই বছরের ৫ নভেম্বর এই ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গঠন করা হয়। কিন্তু এ কমিটি গঠনের পর বছর হতে চলল, তবু কাজ শুরু করা গেল না।
এ সম্পর্কে কমিটির প্রধান ‘বিশেষজ্ঞ’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন বলেন, গত বছরের নভেম্বরের শুরুতে এ কমিটি গঠনের পর থেকেই মুখিয়ে আছি আমরা কবে কাজ শুরু করব। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বনবিভাগ বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে।
এ সম্পর্কে কমিটির অন্যতম সদস্য ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক আবদুল আউয়াল সরকার বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে বনভুমি, বনজ সম্পদ, জীববৈচিত্র ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে গঠিত ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’র কর্মকান্ড চালানোর জন্য এখনও কোন অর্থ বরাদ্দ আসেনি। ফলে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজও শুরু করা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির জানান, মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ প্রকল্পে যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি নির্ণয় করা হয়েছে, সেই পদ্ধতিতেই উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বনজ ও জীববৈচিত্রের ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি ব্যবহার করা হয়নি।

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেখানে সৃজিত বন, প্রাকৃতিক বন ও আর জীববৈচিত্রের মূলত তিনভাগে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজধানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রফেসর রাগিবউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা প্রকৃতিতে একটি সাপ, একটি শিয়াল অথবা একটি পেঁচার পরিবেশগত সেবার অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করি, তাহলে এর মূল্য দাড়ায় বছরে ২৫ লাখ টাকা। এখন হারিয়ে যাওয়া কয়েকশত প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে যদি একটি গুঁইসাপ প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা ৮০০০টিও ধরা হয়, তাহলে পরিবেশগত অর্থনীতির মূল্যায়ন সূত্র অনুযায়ী কেবল এই এক প্রজাতির প্রাণীর হারিয়ে যাওয়ার কারণে পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে ২০০০ কোটি টাকা।

তিনি জানান, পরিবেশে প্রত্যেক প্রাণীর উপস্থিতি মানুষের অস্তিত্বের জন্যই খুব গরুত্বপূর্ণ হলেও ইঁদুরের মত অনিষ্টকারী প্রাণীর নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে বেড়ে গেলে তা মানুষের জন্য হুমকী হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে ২শ’টি করে ধানের শীষ কাটে। আর একটি গুঁইসাপ, পেঁচা অথবা একটি শিয়াল প্রতিদিন গড়ে ৫০টি করে ইঁদুর শিকার করে। এদের প্রধান খাদ্য ইঁদুর। এভাবে অন্যান্য প্রাণীরও স্ব স্ব কার্যক্রম রয়েছে, যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানান, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় নিম গাছ হল পলিউষন ক্লিনার, যে দূষিত বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে। আর মাত্র ১০ বছর বয়সী একটি তেঁতুল গাছ যে পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন করে তা ১৫০ জন মানুষের জন্য যথেষ্ট। একজন মানুষের অক্সিজেনের জন্য ২৫ বর্গফুটের উদ্ভিদ আচ্ছাদন প্রয়োজন। বৃক্ষ শুধু অক্সিজেন উৎপাদন করেনা, দূষিত কার্বনও শোষণ করে। আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে এই ধরনের লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ ও হাজার হাজার প্রাণী হারিয়ে গেছে। আর হারিয়ে যাওয়া এ বনের কার্বন শোষন ও অক্সিজেন উৎপাদন মূল্যায়ন এবং পশু-পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীর হারিয়ে যাওয়ার পরিবেশগত ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণ জরুরী বলে মনে করেন পরিবেশবিদগণ।