বাবার পরকীয়ার বলি ওয়াসি

আবদুল করিম বিটু, চকরিয়া

দীর্ঘদিনের সম্পর্কের পর কথা ছিল সাহাব উদ্দিন ও মুন্নী আক্তারের বিয়ে হবে। এজন্য সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু মুন্নীর সঙ্গে বিয়ে নিয়ে বাধ সাধেন সাহাব উদ্দিনের অভিভাবকেরা। এতে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের পর তাদের বিয়ে আটকে যায়। এরই মধ্যে রুনা আক্তার নামে একজনের সঙ্গে বিয়ে হয় সাহাব উদ্দিনের।

এ নিয়ে সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে প্রায় সময় পথেঘাটে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হন পুরনো প্রেমিকা মুন্নী আক্তার। এরই জের ধরে সাহাব উদ্দিনের দ্বিতীয় সন্তান আড়াই বছরের আল ওয়াসীকে ফুসলিয়ে অপহরণ করেন। এর পর হত্যা করে লাশ রাতের আঁধারে ফেলে দেওয়া হয় মাতামুহুরী নদীর চরে।

অপহরণের প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর গত মঙ্গলবার সকাল দশটার দিকে শিশুটির লাশ নদীর চরে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ শিশুটির লাশ উদ্ধারের পর ময়না তদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে। পুলিশ জানায়, শিশুটির শরীরের কোথাও আঘাতের তেমন দাগ নেই। তবে নাক-মুখ দিয়ে ফেনা জাতীয় কিছু লালা বের হওয়া অবস্থায় শিশুটিকে পাওয়া যায়। এতে শ্বাসরোধ বা বিষ মেশানো কিছু খাইয়ে শিশুটিকে হত্যা করা হতে পারে বলে পুলিশের ধারণা।

চকরিয়া থানার ওসি মো. বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী জানান, এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না শিশুটিকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে। ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে শিশুটির লাশ কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চকরিয়া পৌরশহরের চিরিঙ্গা সবুজবাগ এলাকায় বাড়ির কাছে সড়কে সোমবার বিকাল চারটার দিকে সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে খেলছিল আড়াই বছরের শিশু মো. আল ওয়াসী। এ সময় বোরকা ও নেকাবে মুখ ঢাকা অচেনা এক নারী আদর করার ছলে ফুসলিয়ে আল ওয়াসীকে কোলে নিয়ে দ্রুত সটকে পড়েন বিলের মাঝখান দিয়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর ওই নারীর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি এপ্রোন বের করে শিশুটিকে ঢেকে নেন। বিলের মাঝখান দিয়ে দ্রুতগতিতে যাওয়ার সময় দুই নারী শ্রমিক শিশু কোলে অচেনা ওই নারীকে দেখতে পায়।

এ বিষয়ে পুলিশ জানায়, দুই নারী শ্রমিকের দেওয়া তথ্য অনুসারে এবং শিশুর বড় বোন চার বছরের ইফতি মণির স্বাক্ষ্যমতে, মুন্নী আক্তারকে রাতেই পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের বাটাখালী খোন্দকার পাড়ার খলিলুর রহমানের বাড়ি থেকে আটক করা হয়। খলিলুর রহমান আটক মুন্নীর বাবা। একইসঙ্গে জব্দ করা হয় পরিহিত বোরকা, এপ্রোন ও ভ্যানিটি ব্যাগও। এ সময় পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুন্নী আক্তার বলছিল, শিশু আল ওয়াসীকে তিনি অপহরণ বা হত্যা করেননি। তবে সাহাব উদ্দিনের কারণে আজ তার (মুন্নী) জীবন শেষ হয়ে গেছে। এমনকি এই বিষয়ে নানা অসংলগ্ন কথাবার্তাও বলতে থাকেন মুন্নী।

আটক মুন্নী আক্তারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর কঙবাজার জেলা পুলিশের চকরিয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার কাজী মো. মতিউল ইসলাম বলেন, শিশু আল ওয়াসীর বাবা সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে নাকি আটক মুন্নী আক্তারের বিয়ে হয়েছিল। সেই দাবি করে মুন্নী আক্তার শুধুই বলছিল, কারো শিশুকে সে অপহরণ বা হত্যা করেনি। তবে সাহাব উদ্দিনের কারণে আজ তার জীবন তছনছ হয়ে গেছে বলে দাবি করে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে মুন্নী আক্তার বলেন, এই জীবনে বেঁচে থাকার আর দরকার নেই।

পুলিশ কর্মকর্তা কাজী মো. মতিউল ইসলাম আরো বলেন, ওই মহিলার সাথে সম্পর্ক থাকতে পারে সাহাব উদ্দিনের। তাই বলে এভাবে একটি নিষ্পাপ শিশুকে নিষ্ঠুর ও নির্মমতায় হত্যা করতে হবে-তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঘটনার পরম্পরা ও প্রাথমিক স্বাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে শিশু আল ওয়াসীকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে ওই নারীর বিরুদ্ধে মামলা নিতে ওসিকে নির্দেশ দিয়েছি।

বাটাখালী খোন্দকার পাড়ার স্থানীয় লোকজন জানান, বান্দরবানের আলীকদমের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল খলিলুর রহমানের কন্যা মুন্নী আক্তারের। কিন্তু বিয়ের দুই বছরের মাথায় দুজনের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

শিশু আল ওয়াসীর মা রুনা আক্তার পুত্রহত্যার খবর শুনে বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর আবার জ্ঞান ফিরলে পুত্রশোকে ডুঁকরে কাঁদছেন।

এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় তিনি জানিয়েছিলেন, গত রবিবার দুপুরে বোরকা ও নেকাব পরিহিত অচেনা এক নারী তার বাড়িতে এসে পরিচয় দেন, একটি এনজিও সংস্থায় তিনি স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত কাজ করেন। তখন কোন এনজিও জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে বাড়িতে বসার জন্য অনুমতি চান এবং ছেলেমেয়ে কয়জন তা জিজ্ঞেস করেন। এ সময় তাকে চলে যেতে বললে ক্ষিপ্ত হয়ে এক পর্যায়ে চলে যান।

ওইসময় রুনা বলেছিলেন, সোমবার বিকালের দিকেও অচেনা ওই নারীকে সবুজবাগ এলাকায় সন্দেহজনক ঘোরাঘুরি করতে দেখেন। এতে আমাদের সন্দেহ জাগছে অচেনা ওই নারীই আমাদের শিশুপুত্রকে অপহরণ করেছে।

শিশুর বাবা চকরিয়া কালার অফসেট প্রেসের মালিক সাহাব উদ্দিন বলেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আমার বুকের ধন আল ওয়াসীকে অপহরণের পর হত্যা করেছে মুন্নী আক্তার।
পূর্ব শত্রুতা বলতে কী, এমন প্রশ্নে সাহাব উদ্দিন বলেন, আসলে বিয়ের আগে মুন্নীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে আমাকে স্বামী হিসেবে না পেয়ে আমার ছেলেকে অপহরণের পর হত্যা করেছে মুন্নী। বিয়ের পর প্রায় ৫ বছর যাবত পথেঘাটে প্রতিনিয়ত মুন্নী আমার সঙ্গে ঝগড়া করত, সম্মানহানি করত। এ সময় নানা ধরনের হুমকিও দিত।

শিশুর মা রুনা আক্তারের মামা পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজাউল করিম বলেন, শিশুটিকে ফুসলিয়ে কোলে তুলে যদি সবুজবাগ সড়ক দিয়ে যেত তাহলে বেশ কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধরা পড়ত। এজন্য অপহরণকারী ওই নারী বিলের মাঝখান দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।

এ বিষয়ে ওসি মো. বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমরা আশপাশের আরো কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার জন্য চেষ্টা করছি, যাতে মামলার মেরিট ভবিষ্যতেও ঠিক থাকে। এ ঘটনায় মামলা রুজুর প্রস্তুতি চলছে।