মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস আজ

অনলাইন ও মোবাইলে চলছে মাদক কারবার

সমকাল ◑
কক্সবাজারের টেকনাফকে বলা হয়ে থাকে ‘ইয়াবার রাজধানী’। মিয়ানমার থেকে ঢুকে অধিকাংশ ইয়াবার চালানই টেকনাফ হয়ে দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে। করোনার এই মহামারি কালেও থেমে নেই ইয়াবা কারবার।

নতুন নতুন কৌশলে চালান দেশে প্রবেশ করার পর পণ্যবাহী যানবাহনে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। কখনও আবার যাত্রীবাহী বাস, অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি সেবায় নিয়োজিত কোনো বাহনকে ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। অনলাইন ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে বড় বড় চালান মাঝারি কারবারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে যাচ্ছে। অনলাইনে নানা গ্রুপ খুলে করোনার এই সময়ে চলছে মাদকের রমরমা বিকিকিনি। করোনাকালেও প্রায়ই কক্সবাজারসহ দেশের নানা এলাকা থেকে ধরা পড়ছে মাদকের চালান। গ্রেপ্তার হচ্ছে মাদক কারবারি।

আজ মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘শুদ্ধ জ্ঞানেই সঠিক যত্ন হবে, জ্ঞানের আলোয় মাদক দূর হবে।’ করোনার কারণে দেশব্যাপী অত্যন্ত সীমিত পরিসরে দিবসটি পালন করবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদকবিরোধী প্রচার কার্যক্রম চালানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

মাদকের সর্বব্যাপী বিস্তার ঠেকিয়ে তরুণ প্রজন্মকে এর অভিশাপ থেকে রক্ষায় ২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে বিশেষ অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এরপর পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাও মাদকবিরোধী অভিযান চালায়। অভিযানে এখন পর্যন্ত কয়েকশ’ ব্যক্তি মাদক কারবারে জড়িত থাকায় অভিযুক্ত হিসেবে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়। গ্রেপ্তার হয় কয়েক হাজার। তবু মাদক নির্মূল করা যায়নি। মাদক কারবার চলছেই। করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারিও মাদককে রুখতে পারেনি।

দুই বছরে এক হাজার কোটি টাকার মাদক উদ্ধার র‌্যাবের :র‌্যাবের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালের ৩ মে থেকে চলতি বছরের ২০ জুন পর্যন্ত শুধু র‌্যাব সারাদেশ থেকে এক হাজার তিন কোটি ৭৭ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। এই দুই বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৫১৭ জন মাদক কারবারিকে। হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে ৮৪ কেজি। এক কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৩ পিস ইয়াবা বড়ি, দুই লাখ ৭৪ হাজার ৩০৩ বোতল ফেনসিডিল, আট হাজার ৫৫৪ কেজি গাঁজা, প্রায় দুই কেজি কোকেন, ছয় লাখ ৪৭ হাজার ২১৪টি নেশাজাতীয় ইনজেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়।

মার্চের পর করোনা পরিস্থিতির এই চার মাসে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে সারাদেশে অন্তত দুই হাজার মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করে। ১০ লাখের বেশি ইয়াবা জব্দ করা হয়। গত মে মাসে র‌্যাব ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে মাদক কেনাবেচা করছিল এমন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পায়। ওই গ্রুপের নাম ছিল ‘ওয়েড লাভারস বা গাঞ্জা প্রেমী।’ অনলাইনে অর্ডার নিয়ে মাদকের হোম ডেলিভারি দিচ্ছিল তারা। ওই গ্রুপে অন্তত ১৫ হাজার সদস্য ছিল।

করোনাকালে এ ছাড়া রাজধানীর আগারগাঁওকেন্দ্রিক একটি চক্রের খোঁজ পায় পুলিশ। যারা মূলত সবজি বিক্রেতার আড়ালে মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদক পৌঁছে দেয়। ফোনে অর্ডার নিয়েই তারা এই সিন্ডিকেট সচল রাখছিল।

করোনাকালে মাদক মামলা :পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে সারাদেশে মাদক মামলা হয়েছে সাত হাজার ৬২৫টি। এপ্রিল মাসে এই মামলা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৪০টিতে। মে মাসে মামলার সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪৬৫টি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, স্বাভাবিক সময়ে গড়ে প্রতি মাসে ঢাকায় মাদক উদ্ধারজনিত ২৫০-৩০০ মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। করোনাকালে মামলার সংখ্যা গড়ে মাসে একশ’তে নেমে এসেছে।

ওই কর্মকর্তার ভাষ্য- করোনার এই সময়ে আগের মতো ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালানো সম্ভব নয়। কারণ কোনো একটি ইউনিটের একজন সদস্য করোনা আক্রান্ত হলেই ওই ইউনিটের সব সদস্যকে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হচ্ছে। আবার অভিযান চালাতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। খিলগাঁওয়ে একটি টিম অভিযান চালাতে গেলে ঘরের ভেতর থেকে এক ব্যক্তি বলেন- ‘আমি করোনা রোগী। অভিযান চালাতে আপনারা বিপদে পড়তে পারেন।’ এটা জানার পর অভিযান থেকে সরে আসেন তারা।

বিজিবির উদ্ধার :মাদক ঠেকাতে সীমান্তে দায়িত্ব পালন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। মার্চে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৮২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৪০ হাজার ৩১৪ বোতল ফেনসিডিল, ৯২৮ কেজি গাঁজাসহ নানা মাদক জব্দ করা হয়। বিজিবির অভিযানে এপ্রিল মাসে তিন লাখ ১০ হাজার ৬২১ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ২২ হাজার ৯৫১ বোতল ফেনসিডিল, ৫৬০ কেজি গাঁজা, ৪০০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। মে মাসে চার লাখ ৪৭ হাজার ৮৬৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৩৩ হাজার ৯৩৩ বোতল ফেনসিডিল, এক হাজার ২৮৭ কেজি গাঁজা, এক কেজি ৩৮৩ গ্রাম হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার করে বিজিবি।

করোনার মধ্যেও জব্দ হচ্ছে চালান :মহামারি কালেও দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় প্রতিদিন মাদক উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। গত বুধবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম মেট্রো উপ-অঞ্চলের তিনটি মাদকবিরোধী অভিযানে চার হাজার পিস ইয়াবাসহ চার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- রশিদ আহম্মেদ, ইসমাইল, ফারজানা আক্তার টুম্পা ও মুন্নি আক্তার।

২১ মে রাজধানীর আদাবর এলাকা থেকে ডাব ও কাঁঠালভর্তি একটি পিকআপ জব্দ করে র‌্যাব। সেটিতে ‘জরুরি খাদ্য পরিবহন’ সংবলিত স্টিকার সাঁটানো ছিল। পরে ওই পিকআপের চালক, চালকের সহকারী ও দুই যাত্রীর প্রত্যেকের কাছে সাত হাজার পিস করে ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়। ২৯ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জে একটি লবণবোঝাই কাভার্ড ভ্যান থেকে ৫৯ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাব জব্দ করে র‌্যাব-১১।

৬ এপ্রিল পুলিশ কক্সবাজারে ২০ হাজার পিস ইয়াবাসহ একটি অ্যাম্বুলেন্স জব্দ করে। গত ২ মে টেকনাফে ৫১ হাজার ৬৯৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে বিজিবি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দমদমিয়া বিওপি থেকে দক্ষিণ দিকে হাফিজের জোড়া এলাকার নাফ নদীর তীরে জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় পৃথক দুটি স্থানে পলিথিনে মোড়ানো দুটি ব্যাগ শনাক্ত করা হয়। ওই ব্যাগ খুলে ইয়াবার চালানটি পাওয়া যায়। চালানটি সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

এ ছাড়া ৭ এপ্রিল নাইক্ষ্যংছড়ি রাস্তার মাথা এলাকা থেকে ২০ হাজার ইয়াবাসহ একজন যুবককে আটক করা হয়। ১৭ এপ্রিল চার হাজার ইয়াবাসহ একজনকে আটক করে উখিয়া থানা পুলিশ। একই দিন টেকনাফের শাপলা চত্বর এলাকা থেকে চার হাজার ইয়াবাসহ এক যুবককে আটক করা হয়।

কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, নানা কৌশলে মাদক কারবারিরা সক্রিয়। পণ্যের আড়ালে তারা মাদক পাচারের চেষ্টা করছে। দেশের বাইরে থেকেও কেউ কেউ মাদক সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের আইনের আওতায় নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, মোবাইল ফোনে যোগাযোগ ও অনলাইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মাদক কারবারিরা তাদের নেটওয়ার্ক সক্রিয় রাখছে। অনলাইনে যোগাযোগ করেই অনেক মাদকসেবী মাদক পাচ্ছে। বলা যায়, মাদক এখন মোবাইল নেটওয়ার্ককেন্দ্রিক কারবারে রূপ নিচ্ছে।