মাদক কারবারে দুই থানার ২০ পুলিশ সদস্য!

সমকাল ◑

ঢাকার মাদক রাজ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে- ‘কোথাও মাদক না মিললে কারওয়ান বাজার রেললাইনে চলে যাও। সেখানে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কানে আসবে, কয় গোডা (ইয়াবা) লাগবে। পাতাও (গাঁজা) আছে।’ হাত বাড়ানোর আগেই মাদক নিয়ে হাজির হবে অনেকে। আর এই কারবার চলে অনেকটা প্রকাশ্যে। কোনো ভয়ভীতি নেই মাদক কারবারিদের।

বলা চলে বহুদিন ধরেই কারওয়ান বাজার রেললাইন ধরে মাদক বিকিকিনির এই দৃশ্য পুরনো। তবে মাঝে মাঝে অভিযান চললেও কিছু দিন পর একই চিত্র। এমনকি করোনাকালে সেখানে মাদকের আখড়া আরও জমজমাট হয়ে উঠেছিল।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তেজগাঁও আর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ১৫-২০ অসাধু পুলিশ সদস্য তেজগাঁওকেন্দ্রিক এই মাদক কারবার জিইয়ে রাখতে মূল ভূমিকা পালন করে আসছে। নিয়মিত তারা মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা নেয়। আর্থিক লোভে তাদের কারণেই রেললাইন কেন্দ্রিক মাদক কারবার কখনও পুরোপুরি নির্মূল তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণ করাও কষ্টসাধ্য হচ্ছিল।

মাদক সিন্ডিকেটে যুক্ত পুলিশের অসাধু এসব সদস্যের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া গেলে তেজগাঁওকেন্দ্রিক মাদক কারবার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

একটি নির্ভরশীল সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ২৮ জুন থেকে টানা কয়েক দিন তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড, রেললাইন এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে তেজগাঁওকেন্দ্রিক মাদক কারবারিদের সেকেন্ড ইন কমান্ড শারমিন ওরফে স্বপ্নাসহ অন্তত ২০ মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। মূলত তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই মাদক কারবারে পুলিশের সংশ্নিষ্টতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। পরে গুরুত্ব বিবেচনায় পুরো বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের ওপর। তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই তদন্তে মাদক কারবারে পুলিশের সংশ্নিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে।

সর্বশেষ গত শনিবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক অপরাধ সভায় তেজগাঁওকেন্দ্রিক মাদক কারবারে পুলিশের সংশ্নিষ্টতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। সেখানে প্রসঙ্গটি তোলেন তেজগাঁওয়ের ডিসি হারুন-অর রশিদ। মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা নেওয়ার সঙ্গে জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। এতে ঢাকার ৫০টি থানার ওসি ও পুলিশের সব ইউনিটের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় কমিশনার মাদকের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

গতকাল রোববার এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘মাদক কারবারের বিরুদ্ধে আমরা সবসময় শূন্য-সহিষুষ্ণ নীতি অবলম্বন করছি। এরপর অনেক সময় দেখছি মাদক কারবার নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এর একটি কারণ কোনো ÿেত্রে আমাদেরই দু-চারজন মাদকের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত থাকা। আমরা সেটা হতে দেব না।

পুলিশ নিজে মাদক কারবার বা সেবনে জড়াতে পারবে না। আবার অন্য কেউ জড়ালে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের বলা হয়েছে কোনো এলাকায় মাদকের কারবার চলতে দেওয়া যাবে না। ওসিদের মাদক নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। এই বার্তায় পরিস্কার হয়- ওসিরা তাদের পদে থাকবেন, নইলে মাদক কারবারিরা এলাকায় থাকবে।’

ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, তেজগাঁও কেন্দ্রিক মাদক কারবারে পুলিশের কিছু সদস্যকে আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ মহাপরিদর্শক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, মাদকের ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘সমাজে মাদককে আমরা দুষ্প্রাপ্য করে তুলব। তাই আগে নিজেরা শোধরাব অবশ্যই। মাদক কারবারিদের পুলিশের সখ্য কোনোভাবে মেনে নেওয়া হবে না।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন-অর রশিদ সমকালকে বলেন, ‘মাদক কারবারিদের সঙ্গে দুটি থানার ১৫-২০ সদস্যের সংশ্নিষ্টতার বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে। কয়েকজন মাদক কারবারি গ্রেপ্তারের পর তারাই আমাদের এ তথ্য দিয়েছে। পরে পুলিশ নিজস্ব সূত্রে আরও বিশদভাবে তদন্ত চালায়। জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিএমপি কমিশনারের কাছে চিঠি দেওয়া হবে।

জানা গেছে, মাদক সিন্ডিকেটকে সহায়তা করে যাচ্ছিল এখন পর্যন্ত তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার অন্তত সাত সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন উপপরিদর্শক (এসআই), তিনজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও একজন কনস্টেবল। নেপথ্যে থেকে মাদক কারবারিদের সহযোগিতার দেওয়ার ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করে করেন শিল্পাঞ্চল থানার এসআই কামাল হোসেন।

এ ছাড়া তেজগাঁও থানারও কয়েকজন কর্মকর্তাকে শনাক্ত করা গেছে. যারা মাদক সিন্ডিকেটের যুক্ত। মাদক কারবারে জড়িত এসব পুলিশ সদস্যের নাম প্রকাশ করতে চায়নি ওই সূত্রটি। অসাধু এসব সদস্য মাসোহারা নিয়ে তেজগাঁওকেন্দ্রিক মাদক কারবারে জড়ায়। থানা থেকে অন্য কোনো পুলিশ সদস্য অভিযানে গেলে আগে থেকে অনেক সময় তারা মাদক কারবারিদের জানিয়ে দিত। আবার অনেক সময় নিজেরা নামকাওয়াস্তে অভিযান চালাত।

পুলিশ জানায়, তেজগাঁওয়ে যারা মাদক কারবার করছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বপ্না। তার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা রয়েছে। স্বপ্না ছাড়াও এই চক্রে আছে নূপুর, জাহিদা, ময়না, শিউলী, লিপি, রুবেল, খলিল, রুমু, মোহাম্মদ রুবেল, খোরশেদ আলম পনির ও রাজু পাটোয়ারী।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি আলী হোসেন বলেন, ‘মাদক নির্মূলে শতভাগ শক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করব আমরা। তেজগাঁও রেললাইনকেন্দ্রিক মাদক কারবারিদের অনেকে শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।’