মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত শিক্ষার্থীদের

ইন্দ্রজিৎ সরকার

’ভার্সিটির দোতলায় বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখনই জানতে পারি, পাশের একটি ভবনে আগুন লেগেছে, তাই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদের নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে দেখি দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। এফ আর টাওয়ার ও পাশের ভবনের সাত-আটতলা থেকে কেউ কেউ তার বা পাইপ বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে একজন হাত ফসকে নিচে পড়ে গেলে আমরা ছুটে যাই। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।’ রাজধানীর বনানীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র গোলাম মোস্তফা মিজান এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। 

শুধু মিজানই নন, গতকালের অগ্নিকাণ্ডের সময় বনানী ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো ছাত্র ছুটে যান ঘটনাস্থলে। আহতদের উদ্ধার তৎপরতায় সহায়তা, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স আসার পথ তৈরি করে দেওয়াসহ নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন তারা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরতিহীনভাবে কাজ  করে তারা মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

আগুনের ঘটনাস্থল বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ ও আশপাশের এলাকায় নর্দান, প্রাইম এশিয়া, সাউথ ইস্ট, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি) ও সিটি ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রয়েছে। তাই কেউ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে, আবার কেউ সামান্য পরে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও। 

প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শাকিল আহমেদ আকাশ বলেন, ‘আগুনের খবর শুনে সেখানে গিয়ে দেখি, ষষ্ঠ তলার কাচ ভেঙে নিচে পড়ে গেল। আর ওই ফাঁকা স্থান দিয়ে বেরিয়ে এলো আগুনের শিখা। বিস্ম্ফোরণের মতো একটি শব্দও শুনেছি। তখন (১২টা ৪৯ মিনিটে) আমি ফায়ার সার্ভিসে ফোন করে ঘটনাটি বলি। তারা জানায়, আগেই এ সম্পর্কে জানতে পেরেছে। ততক্ষণে ভবনে আটকেপড়া লোকজন ঝুঁকি নিয়ে ডিশের তার ধরে ঝুলে নামার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হচ্ছেন। আমি বন্ধুদের নিয়ে আহতদের উদ্ধারের কাজে লেগে পড়ি।’

নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সজীব চন্দ্র ঘোষ জানান, সাউথ ইস্ট ও এআইইউবিসহ সেখানকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা ফায়ার সার্ভিস ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নানাভাবে সহায়তা করেন। তাদের বেশির ভাগই দুপুরে খাওয়ার সুযোগ পাননি। সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেকে পানি পানেরও সুযোগ পাননি। কারণ আগুনের কারণে সব প্রতিষ্ঠান দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সফুরা টাওয়ারের ‘লংকাবাংলা ফাইন্যান্স’-এর মেইনটেন্যান্স বিভাগের প্রধান লিংকন রোমিও পেরেরা জানান, আগুন লাগার সময় তিনি পাশের একটি ভবনে ছিলেন। আগুনের বিষয়টি জানতে পেরে দ্রুত এফ আর টাওয়ারের সামনে ছুটে যান। তখন উৎসাহী মানুষ ভবনের সামনে ভিড় করে ছিলেন। তাদের কারণে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কাজে অসুবিধা হচ্ছিল। পাশাপাশি আগুন লাগা ভবন থেকে কাচের টুকরা বা কিছু নিচে পড়ে গেলে তারাও আহত হতে পারেন। এ কারণে লিংকন অন্যদের সহায়তায় লোকজনকে সরিয়ে দেন, তৈরি করেন নিরাপত্তা বেষ্টনী। 

এদিকে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে ঘটনাস্থলে যায় বনানীর ১৭ নম্বর সড়কের চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান ‘প্রাভা হেলথ’ এর একটি দল। ওই দলে সাতজন চিকিৎসক ছাড়াও নার্সসহ অন্যরা ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কবির আহমেদ খান জানান, আগুনের ঘটনায় আহত তিনজনকে তাদের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান উদ্ধারকর্মীরা। তখন ঘটনার ভয়াবহতা বুঝে তারা দ্রুত একটি মেডিকেল টিম তৈরি করেন। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। সেখানে অন্তত ৩৩ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গুরুতর আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। 

প্রাভা হেলথের চিকিৎসক মারিহা আলম চৌধুরী ও ডা. লুবনা শারমীন জানান, আহতদের মধ্যে নারী-শিশুদের চিকিৎসার বিষয়টি তিনি দেখভাল করেন।