মুক্তির মহানায়ক লাল সালাম

ডেস্ক রিপোর্ট ◑

আমার জন্মদিনই কী আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমি তো আমার জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।’ নিজের জন্মদিন সম্পর্কে এ কথা বলতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সময়ের আবর্তে বর্ষপঞ্জির আকাশে গতকাল মঙ্গলবার ১৭ মার্চ দেখা দিয়েছিল সেই মানুষটির শততম জন্মবার্ষিকী, যিনি নিজে কখনও জন্মদিন উদযাপন করেননি। গতকাল এ দেশের মানুষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাভরে পালন করেছে মুক্তির এই মহানায়কের জন্মশতবার্ষিকী, জানিয়েছে লাল সালাম- কেননা বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।
বাঙালি জাতিকে যিনি দিয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও সংবিধান, দেশের মানুষ যাকে ভালোবেসে ডাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে, স্বীকৃতি দিয়েছে জাতির পিতা হিসেবে- সেই অবিসংবাদিত নেতার শততম জন্মবার্ষিকীকে বাংলার মানুষ চেয়েছিল সাড়ম্বরে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে উদযাপন করতে। সে অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক আকারে মুজিববর্ষ পালনের পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম শুরুও হয়েছিল। কিন্তু মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা পর্বেই বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টে যায় সামগ্রিক পরিস্থিতি। জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সংক্ষিপ্ত করা হয় মুজিববর্ষ উদযাপনের কর্মসূচি।
তবে কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করার এবং জনসমাগম এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও গতকাল বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীতে বাঙালির আবেগ ও ভালোবাসার প্রকাশে কোনো ছন্দপতনই ঘটেনি। যে মহাপুরুষের পুরো জীবনই নিবেদিত ছিল জনগণের জন্য, পারিবারিক জীবনযাপন দূরে থাক- বরং পরিবারসহ নিজের জীবনকেও দেশের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন যিনি- তার জন্মদিনে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের আবেগ ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে নানাভাবে।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচির বাইরেও তাই গতকাল অসংখ্য মানুষকে দেখা গেছে রাজধানীতে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিমুখো হতে- বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। অনেকেরই গন্তব্য ছিল গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিসৌধ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার দৃঢ় শপথ নিয়েছে গোটা জাতি।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন প্রতিবছর ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষে সোনার বাংলা, ছড়ায় নতুন স্বপ্নাবেশ; শিশুর হাসি আনবে বয়ে, আলোর পরিবেশ’। পরিকল্পনা ছিল, এবার এ দিবসে, শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্কুল-কলেজে বিভিন্ন কর্মসূচি উদযাপন করা হবে। বাবাকে নিয়ে শিশুদের উদ্দেশে লেখা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একটি চিঠি কোটি শিশু একসঙ্গে পাঠ করবে। কিন্তু কর্মসূচি সংক্ষেপ করে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে চিঠিটি শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত ৮টায় টুঙ্গিপাড়ায় জন্মেছিলেন বাঙালির আরাধ্য মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গতকাল জন্মশতবার্ষিকীর মূল আয়োজনের উপলক্ষ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এ ক্ষণকেই। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক যখন রাত ৮টা, তখনই রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আতশবাজির মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুজিববর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণের উচ্ছ্বাস। রাত ১০টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় পিক্সেল ম্যাপিং প্রদর্শনের মাধ্যমে মুজিববর্ষের এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। রাত ৮টায় দেশের বিভিন্ন স্থানেও মানুষ মেতেছিল আতশবাজি উৎসবে।
তবে জনসমাগম এড়াতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আতশবাজি উৎসব এবং জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় পিক্সেল ম্যাপিং প্রদর্শনের মাধ্যমে মুজিববর্ষের উদ্বোধনপর্বটি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একযোগে সম্প্রচার করা হয়। আতশবাজির পরপর ‘মুক্তির মহানায়ক’ শিরোনামে দু’ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়।
ধারণকৃত এই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ প্রচার করা হয়। একই অনুষ্ঠানে অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিশ্বনেতা ও সংস্থাপ্রধানদের পাঠানো ভিডিওবার্তাও প্রচারিত হয়। ভিডিওবার্তা পাঠানো পাঁচ বিদেশি ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং ওআইসির মহাসচিব ইউসেফ বিন আহমেদ আল-ওথাইমিন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ভিডিওবার্তায় করোনাভাইরাসের কারণে মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর মহৎ ব্যক্তিদের একজন, যার পুরো জীবন আমাদের জন্য মহৎ প্রেরণা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছেন।
ভিডিওবার্তায় নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশের স্বাধীনতা এবং জনগণ ও ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন। নেপাল ও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুসম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে এই সম্পর্ক উত্তরোত্তর বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন নেপালের রাষ্ট্রপতি।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় নেতৃত্বকে স্মরণ করে মুজিববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলেন, ‘আজকে আপনাদের জাতির পিতার জন্মের ১০০ বছর পূর্তিতে আপনাদের শুভেচ্ছা জানাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ।’ এ সময় ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভুটানের জনগণও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছে এবং এক হাজার ‘ঘি প্রদীপ’ জ্বালিয়ে তার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করেছে। এর আগে বিকেলে লোটে শেরিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে তাকেসহ বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানান।