ঘূর্ণিঝড় মোখায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বাড়াচ্ছে কক্সবাজারের বনাঞ্চল উজাড়

বিশেষ প্রতিবেদক •

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের দিকে দ্রুতগতিতে ধেয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় মোখা, যা এরই মধ্যে শক্তি বাড়িয়ে পরিণত হয়েছে মারাত্মক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে।

১৪মে  রবিবার দুপুরের দিকে কক্সবাজারের উখিয়া,টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন এবং মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলে তা আছড়ে পড়তে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাচ্ছে, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে বড় জলোচ্ছ্বাসের।

এরই মধ্যে কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ’৯১-এর পর আবার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী হতে চলেছে কক্সবাজারের বাসিন্দারা। তবে উপকূলীয় এলাকার বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় এবারের ক্ষতিটা বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা জানিয়েছেন, কক্সবাজারে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে এতদিন কাজ করেছে উখিয়া,টেকনাফ,মহেশখালী ও চকরিয়াসহ আশপাশের বনাঞ্চল। বছরখানেক আগেও সেখানে ছিল মিনি সুন্দরবন। একসময় যার আয়তন ছিল প্রায় ৪৫ হাজার একর। সে জমি লিজ নিয়ে নির্বিচারে বন উজাড়ে নামেন প্রভাবশালীরা। কাগজ-কলমে এখন ২১ হাজার একর বনাঞ্চল থাকলেও বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও নেই। কেওড়া, বাইন ও নুনিয়া গাছের বনটির অস্তিত্ব বিলীন করে সেখানে চলছে চিংড়ি ও লবণ চাষ। টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া,সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়ার মতো উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয়ও ছিল ম্যানগ্রোভ বন।

কক্সবাজারে ম্যানগ্রোভ বন আশঙ্কাজনক হারে কমার বিষয়টি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন বন অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস।  তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পরিমাণ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। মহেশখালী ও চকরিয়ার মিনি সুন্দরবনের জমি লিজ দেয়ার ফলে সেখানেও বনাঞ্চল কমেছে। নিয়মিতই আমরা এসব বিষয়ে বলে থাকি। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বাড়ানোর কথা বলি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শোনে না। এখন দুর্যোগ এসেছে, বনের কদর নিয়ে এখন সবাই সোচ্চার হবে। ঘূর্ণিঝড় কমে গেলে আবার সবাই বনের কথা ভুলে যাবে।’

কক্সবাজারে গত তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বনাঞ্চলের বড় অংশ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। এর আগে এ অঞ্চলে ব্যাপক বনাঞ্চল ছিল। ম্যানগ্রোভের পাশাপাশি সাধারণ বনাঞ্চলও কমেছে ব্যাপক হারে। শুধু রোহিঙ্গাদের জন্যই ১০ হাজার একর বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য উজাড় করা হয়েছে বলে জানান পরিবেশবাদীরা। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্প অ্যান্ড ফরেস্ট লস ইন কক্সবাজার, বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বনভূমি উজাড়ের পরিমাণ বেড়েছে তিন দশক ধরে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা সেখানে বসতি গড়ার পর আরো বড় আকারে বনভূমি উজাড় হতে থাকে।

কাগজে-কলমে কক্সবাজারের মোট ভূমির মধ্যে বনের পরিমাণ ৫২ হাজার ৬২৯ হেক্টর। স্যাটেলাইট ইমেজ ও রিমোট সেনসিং ডাটা ব্যবহার করে দেখা যায়, ২০১৭-২০ সাল পর্যন্ত—এ তিন বছরে ১২ হাজার ৮০৭ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের কারণে বনভূমি উজাড় হয়েছে ১ হাজার ৩৩৭ হেক্টর। এর মানে দাঁড়াচ্ছে বাকি ১১ হাজার ৪৭০ হেক্টর বনভূমিই উজাড় হয়েছে স্থানীয়দের মাধ্যমে।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ২০১৭ সালে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য যে ক্যাম্প করা হয় তার এক থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বনভূমি উজাড়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সে গবেষণায়। এ বিষয়ে গবেষকরা বলেন, ‘আমরা দেখেছি, শরণার্থী শিবিরের এক থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বাইরে আরো ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়। কিন্তু এতে রোহিঙ্গাদের কোনো হাত নেই।’ গবেষকরা দাবি করেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে ক্রমেই স্থানীয়রা এসে বসতি গড়ছেন। ফলে এদের হাতেই এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সরকারের সংশ্লিষ্টরা যদিও কক্সবাজারের বনভূমি ধ্বংস নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত নন। বন বিভাগের দাবি, রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আট হাজার একর জমির বন ধ্বংস হয়েছে। এ ক্ষতির পরিমাণ দিন দিনই বাড়ছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের কারণে ধ্বংস হওয়া বনাঞ্চলের ক্ষতির মোট আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা হয়েছে ২ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়ার কারণেই ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে রোহিঙ্গারা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। গোটা বনাঞ্চল উজাড় হয়েছে তাদের কারণেই। তারা বনসম্পদ ব্যবহার করে খুঁটি বানিয়েছে, ঘর বানিয়েছে। বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। এখন এলপিজির ব্যবস্থা হলেও রোহিঙ্গাদের জ্বালানির প্রয়োজনে অনেক বন নষ্ট হয়েছে। তাদের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে, সড়ক হচ্ছে। এসব কারণেও ব্যবহার করতে হয়েছে বনের একটি অংশ। দখলের যে ঘটনা ঘটছে সেগুলো খুবই কম, যা শনাক্ত হলে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।’

পরিবেশবিদরা অবশ্য বলছেন, বন উজাড় যার হাতেই হোক না কেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঠিকই এর খেসারত দিতে হচ্ছে। তাই নতুন করে বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে না পারলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির হার বাড়বে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলার সভাপতি ফজলুল করিম চৌধূরী বলেন, ‘এক বছর আগেও চকরিয়ার বিশাল অংশজুড়ে মিনি সুন্দরবনের শেষ চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল। এখন সেখানে কিছুই নেই।

এছাড়া আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ১৭ হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন ছিল, যা ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। সেটাও নির্বিচারে উজাড় করা হয়েছে। গত দুই মাসেই মহেশখালী অঞ্চলে ৩০০ একর ম্যানগ্রোভ বন উজাড় হয়েছে। ছয় মাসের হিসাবে এটা দাঁড়ায় প্রায় ৭০০ একরের বেশি। স্থানীয় প্রভাবশালী, প্রশাসন ও বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই উজাড় হয়েছে এসব বনাঞ্চল। ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আমরা যে ভয় পাইনি, বন উজাড়ের ফলে এখন সে ভয় পাচ্ছি। আশ্রয়ের জন্য হাহাকার করছি।’

বঙ্গোপসাগরে গত তিন দশকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর বেশির ভাগই সুন্দরবন কিংবা আশপাশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছে। ফলে সুন্দরবনের কারণে প্রবল ঘূর্ণিঝড়েও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম ছিল। প্রাকৃতিক রক্ষকবচ উজাড় হওয়ায় কক্সবাজারে মোখার আঘাত ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক ড. দিলারা জাহিদ।

তিনি বলেন, ‘খুলনা-সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এ অঞ্চলের জন্য সুন্দরবন হচ্ছে প্রকৃতির আশীর্বাদ। একইভাবে কক্সবাজারেও ব্যাপক ম্যানগ্রোভ বন ছিল। কিন্তু সেটা নিজ হাতে ধ্বংস করেছি। আমরা শঙ্কা করছি, জলাবায়ু পরিবর্তনজনিত যে ঝুঁকিতে আছি, এর ফলে কক্সবাজার এলাকার মানুষ আরো দুর্যোগের কবলে পড়বে। কিন্তু সে তুলনায় সরকারের প্রস্তুতি এখনো যথার্থ নয়। এ বিষয়টিও নজরে আনা উচিত।’

কক্সবাজারের উপকূল এলাকার ম্যানগ্রোভ বন, কেওড়া বন, মিনি সুন্দরবন ধ্বংসের পেছনে সরকারি-বেসকারি বড় কাঠামোগুলোর দায়ও কোনো অংশে কম নয় বলে মন্তব্য করেছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ এজাজ।

তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারে কোহেলিয়া নামে ছোট্ট একটি নদী ছিল। এর আশেপাশে পুরোটাই ছিল ম্যানগ্রোভ বা প্যারাবন। সে প্যারাবন উজাড় করে ও নদী ভরাট করে এখন মাতারবাড়ীর মেগা অবকাঠামোগুলো নির্মাণ হচ্ছে। বাঁকখালী নদীর আশপাশের প্যারাবন নিধন ও নদীটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে গড়ে তোলা হয়েছে হাউজিং। ফলে কক্সবাজারের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে এখন আর সেখানে প্রাকৃতিক কোনো রক্ষাকবচ নেই।’

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এজাজ আরো বলেন, ‘কক্সবাজারে দুর্যোগ এটাই শেষ নয়; এখানে আরো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আসবে। মেরিন ড্রাইভে ভাঙন ধরেছে। আস্তে আস্তে অন্যান্য অবকাঠামোও ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করছি আমরা। নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংসের ফলে ফিরতি যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে কক্সবাজারে সেটার শুরু হয়েছে কেবল। এর শেষ কোথায় এবং কতটা ভয়ংকর তা আগামী দিনগুলোয় দৃশ্যমান হবে। এ থেকে বাঁচতে হলে বনাঞ্চল বাড়াতে হবে এবং টিকে থাকা বনাঞ্চল রক্ষায় সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।’