যেভাবে এলো সেলাই মেশিন

বর্তমানে লাখ লাখ মানুষের জীবিকার উৎস হলো ‘সেলাই মেশিন’। শহর পেরিয়ে গ্রামে এমনকি অজপাড়া গায়েও সেলাই মেশিনের চাহিদা তুঙ্গে। তবে আমরা ক’জনই বা সেলাই মেশিনের উদ্ভাবন সম্পর্কে জানি! হাতের সেলাই এবং কারুকাজের ইতিহাস বাদ দিয়ে কখনোই সেলাই মেশিনের অস্তিত্ব চিন্তা করা যায়না।

প্রায় ২০ হাজার বছর আগে মানুষ প্রথমে হাতে সেলাই শুরু করা শুরু করে। প্রাণীর হাড় এবং শিং থেকে প্রথম সুঁচ তৈরি হয়। প্রথমদিকে প্রাণীর পেশির তন্তুকে সুতা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর পরবর্তী ইতিহাস শুধুই অগ্রগতির।

মানুষের অসীম আগ্রহ এবং প্রচেষ্টার ফলে পরবর্তীতে সেলাই শিল্পে নিরন্তর অগ্রগতি এসেছে। সেলাই পদ্ধতিতে নানা পরিবর্তনের ফলে পরিশ্রমও বহুলাংশে লাঘব হয়েছে। ১৮ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে হাতে সেলাই এবং কারুকাজ প্রক্রিয়ায় রাতারাতি পরিবর্তন আসে এবং চূড়ান্তভাবে মেশিনভিত্তিক সেলাই শিল্পের সূত্রপাত ঘটে। ১৭৯০ সালে সেলাই মেশিনের ১ম নকশা প্রণীত হয়। কাজটি করেন ব্রিটিশ নাগরিক থমাস সেইন্ট। এই মেশিনের পেটেন্ট আবেদনে ‘চামড়া এবং ক্যানভাস সেলাই করার জন্য হাতে পরিচালিত এবং হাতলবিশিষ্ট’ একটি মেশিনের উল্লেখ করা হয়। থমাস সেইন্টের নকশার প্রায় ৪০ বছর পরে প্রথম কোনো কার্যকরী সেলাই মেশিন পৃথিবীতে আসে। বার্থেলেমি থিমোনিয়ার নামের এক ফরাসি দর্জি এই মেশিনটি তৈরি করেন। ১৮৪৪ সালে জন ফিশার নামের একজন ইংরেজ এই সেলাই যন্ত্রে ব্যবহৃত অংশগুলোর মধ্যে সমতা আনেন। তিনি তার তৈরি সেলাই যন্ত্রের নকশার জন্য পেটেন্ট আবেদনও করেন, কিন্তু পেটেন্ট অফিসে কোনো এক জটিলতার কারণে ফিশার তার নকশার পেটেন্ট পেতে ব্যর্থ হন।

পরবর্তীতে মার্কিন নাগরিক এলিয়াস হউ ফিশারের নকশায় কিছুটা পরিবর্তন এনে একটি সেলাই যন্ত্র তৈরি করেন। তার নকশার পেটেন্ট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, যন্ত্রনির্ভর সেলাই এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে সেলাইয়ে ব্যবহৃত সুতা মূলত দুটো থ্রেড থেকে আসে। সেলাইয়ে ব্যবহৃত সুচের মাথায় একটি ছিদ্রে একটি থ্রেডের সুতা এবং কাপড়ের নিচে থেকে অন্য থ্রেডের সুতা আসে। এই সেলাই প্রক্রিয়ার নাম দেয়া হয় ‘লকস্টিস’। এলিয়াস তার সেলাই যন্ত্রের নকশা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিপণন করার জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। ইংল্যান্ডে বেশ কিছুদিন থাকার পরে তিনি তার নিজের দেশে ফেরত আসলে দেখতে পান, অনুমতি ছাড়াই অনেকেই তার নকশা ব্যবহার করে ইতোমধ্যে সেলাই মেশিন তৈরি করে ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইজাক মেরিট সিঙ্গার।

আইজাক মেরিট সিঙ্গারকে আধুনিক সেলাই মেশিনের পথিকৃৎ বলা হয়। তিনি ‘সিঙ্গার কোম্পানি’ নামে যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন তা আজ ইলেকট্রনিক্স জগতে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। সিঙ্গার কোম্পানির সবচেয়ে প্রথম এবং পুরনো পণ্য হচ্ছে সিঙ্গার সেলাই মেশিন। আজকের দর্জি দোকানে যেসব সনাতন সেলাই মেশিন দেখা যায়, সেগুলো মূলত আইজাক সিঙ্গারের নকশায় অনুপ্রাণিত। সুন্দর, সুসজ্জিত এবং ঐতিহ্যবাহী এই সেলাই মেশিনে পায়ের প্যাডেল এবং উপর-নিচ সুচের ব্যবহার রয়েছে। আইজাক সিঙ্গার মূলত তার নকশায় হউ, হান্ট এবং থিমোনিয়ারের নকশার সুন্দর এক সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। অনুমতিবিহীন নকশা ব্যবহারের জন্য পরবর্তীতে তাকে হউ আদালতে হাজির করেন।

পেটেন্ট মামলায় এলিয়াস হউ জিতে যান। সিঙ্গার যদিও নিজের পক্ষে এই যুক্তি দেখান যে, তিনি ওয়াল্টার হান্টের নকশা অনুসরণ করেছেন। কিন্তু আদালত হান্টের নকশার কোনো পেটেন্ট না থাকার কারণে এই যুক্তি খারিজ করে দেন। জরিমানা হিসেবে এলিয়াস হউ সিঙ্গার কোম্পানির লভ্যাংশের একটি অংশ পাবেন বলে আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করে। হেরে যাওয়ার পরেও সিঙ্গার এবং তার প্রতিষ্ঠিত ‘আই.এম.সিঙ্গার অ্যান্ড কোং’কোম্পানির ইতিহাস শুধুই লাভের। হউ এবং সিঙ্গার দু’জনেই মাল্টি-মিলিয়নিয়ার হিসেবে মারা যান। আজ সিঙ্গার কোম্পানি কিন্তু শুধু সেলাই মেশিন নয়, বরং আরও নানা ইলেকট্রনিক পণ্য সম্ভারের জন্য সবার কাছে এক সুপরিচিত নাম।

হাতে সেলাইয়ের পরিবর্তে সেলাইয়ে মেশিন তৈরিতে বহু উৎসাহী মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাদের নানা প্রচেষ্টা নানা সময়ে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু থেমে থাকেনি সেলাই যন্ত্র তৈরির এই প্রচেষ্টা। এসব উৎসাহী এবং পরিশ্রমী মানুষদের কল্যাণেই আজ আমরা আধুনিক এক বস্ত্রশিল্প উপভোগ করছি। প্রাচীন সময়ের প্রাণীর চামড়া দিয়ে লজ্জা নিবারণ আর এখনকার বস্ত্র শিল্প এবং আধুনিক সেলাই প্রযুক্তির মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব।